আমার কাহাফ ভাবনা - ৯ | আরিফ আজাদ
তাফসিরকারকগণ বলেছেন— আসহাবে কাহাফের যে যুবকদের কথা কুরআন আমাদের জানাচ্ছে, তারা সাধারণ কোন পরিবার থেকে উঠে আসেনি৷ অনেকের মতে— ওই সময়কার সবচেয়ে অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলো তারা। এমনকি, কারো কারো মতে— আসহাবে কাহাফের যুবকেরা ছিলো ওই সময়কার নেতৃস্থানীয় লোকেদের সন্তান।
এখানে একটা ব্যাপার বেশ লক্ষ্যনীয়। চারপাশে আমরা দেখি— অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা সাধারণত বখে যায়। তারা নেশায় বুঁদ থাকে, রাত-বিরাতে মাতলামি করে বেড়ায়, মেয়ে আর মদ ছাড়া তাদের দিন কাটে না। অধঃপতনের চরম সীমা যাকে বলে— তার ষোলকলা পূর্ণ থাকে আমাদের বড়লোক আর এলিট শ্রেণীর সন্তানদের মাঝে।
আসহাবে কাহাফের ওই যুবকদলও এরকম বড়লোক, নেতৃস্থানীয় আর এলিট শ্রেণী থেকে উঠে আসা, কিন্তু কী আশ্চর্য— তাদের পুরো জনপদে যখন আল্লাহর ইবাদাত করার মতো কেউ আর অবশিষ্ট নেই, সবাই যখন আল্লাহকে ভুলে নতুন নতুন উপাস্যের উপাসনায় নিয়োজিত, তখন বড়লোক পরিবারের কতিপয় সন্তান, সোনার চামচ মুখে পুরে যাদের জন্ম, যারা বড় হয়েছে অঢেল আভিজাত্য আর সম্পদের মাঝে, যারা কোনোদিন ক্ষুধার দুঃখ অনুভব করেনি, যারা কোনোদিন অর্থ-কষ্ট কী জিনিস বুঝতে পারেনি, যারা চারপাশে রাশি রাশি সম্পদের পাহাড়, ক্ষমতার ব্যবহার দেখে অভ্যস্ত, তারা কী দুঃসাহসিক একটা কাজ করে বসলো!
তারা ঠিক করলো— এই লোকালয় ছেড়ে, এই বিভ্রান্ত জনপদ ছেড়ে তারা পালাবে। এখানে থাকতে হলে যেহেতু লোকেদের মিথ্যা উপাসক, মিথ্যা ইলাহদের উপাসনা করতে হবে, তার চাইতে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে পালিয়ে যাওয়াই উত্তম।
একদিন তারা সত্যিই পালালো। পেছনে রেখে গেলো তাদের আভিজাত্য, অভিজাত পরিবার, বড়লোক বাবা-মা, ক্ষমতার বলয়, সোনায় সোহাগা সংসার— সবকিছু!
পালিয়ে তারা কোথায় যাচ্ছে? তারা যাচ্ছে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে, যে গন্তব্যে তাদের জন্য কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে তার বিন্দুবিসর্গও তারা জানে না। আগের দিনও বাহারি পদ দিয়ে আহার করা যুবকেরা জানে না নতুন গন্তব্যে কী দিয়ে তারা আহার করবে বা কোনো আহারাদি তাদের কপালে আদৌ জুটবে কি-না। সুন্দর জামা-কাপড় পরিধানে অভ্যস্ত যুবকেরা জানে না গায়ের কাপড়টা ছাড়া আর কোন কাপড় কোনোদিন পরবার সৌভাগ্য তাদের হবে কি-না। চারপাশের বন্ধু-বান্ধব, গোছানো সংসার ছেড়ে তারা যেখানে যাচ্ছে সেখানে তাদের জন্য পথ চেয়ে নেই কোন বন্ধু কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী।
ভাবুন তো— কেবল ঈমান বাঁচাবার তাগিদে আপনাকে ছাড়তে হচ্ছে আপনার বড়লোকি গৃহ, আপনার আপন পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আপনার গোছানো সংসার, এতোদিনকার সকল মধুময় স্মৃতি। কেবল তা-ই নয়, সারাজীবন স্বাচ্ছন্দ্য আর স্বচ্ছলতায় কাটানো আপনাকে বরণ করতে হচ্ছে এক অনিশ্চিত নিয়তি। কী নিদারুন কষ্টের না ব্যাপারটা? অথচ, আসহাবে কাহাফের যুবকদল কতো অবলীলায় বরণ করে নিয়েছিলো সেই ভাগ্য!
আসহাবে কাহাফের যুবকদল আমাকে শেখায়— আমার ঈমানের কাছে, আমার দ্বীনের কাছে দুনিয়ার সকল আভিজাত্য, সকল সম্পর্ক, সকল ক্ষমতার বাহার, সকল সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য মূল্যহীন। তারা আমাকে শিখিয়ে গেছে— যদি দ্বীন অথবা দুনিয়া, দুটোর যেকোন একটাকে বেছে নিতে বলা হয়, আমি যেন নিশ্চিন্ত মনে, নির্ভাবনায় দ্বীনটাকে বেছে নিই। আমার অঢেল সম্পদের পাহাড়, আমার অভিজাত পরিবার, স্বজনদের মায়ার কাছে আমি যেন আমার আখিরাত বিক্রি করে না দিই।
আমার কাছে আরো আশ্চর্য লাগলো— এতো আভিজাত্য, এতো সহায়-সম্পদ আর প্রাচুর্যের মাঝে বেড়ে উঠার পরেও কাড়ি কাড়ি টাকা, বাড়ি-গাড়ি, নাম-যশ আর ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার কখনোই তাদের কাছে 'সাফল্য' হয়ে উঠতে পারেনি। জানেন, সাফল্য বলতে তারা কী বুঝতো?
দীর্ঘকালের এক ঘুম থেকে জেগে উঠার পরে, যখন তাদের একজনকে লোকালয়ে খাবার কিনতে পাঠানো হচ্ছিলো, তখন তাদেরই একজন বলছিলো:
'তারা (লোকালয়ের লোকেরা) যদি তোমাদের ব্যাপারে জেনে যায়, তাহলে তারা তোমাদের পাথর মেরে হত্যা করবে অথবা তোমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তাদের অনুসৃত ধর্মে। এতে করে তোমরা কখনোই সাফল্য লাভ করতে পারবে না'।- আল কাহাফ ২০
তারা বলছিলো— জনপদের লোকেরা যদি তাদের চিনে ফেলে, তাহলে আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের কারণে হয় তাদের পাথর মেরে হত্যা করবে, নয়তো তাদের বাধ্য করবে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য উপাস্যের উপাসনা করার জন্যে। যদি তা হয়, অর্থাৎ, আল্লাহর স্থলে যদি অন্যকোন উপাস্যকে তারা গ্রহণ করে বসে, হোক তা বাধ্য হয়ে হলেও, তাহলে তারা সাফল্য লাভে ব্যর্থ হবে।
ভাবুন তো— একটা নির্জন গুহার মধ্যে বসে, পেটে রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে যুবকেরা কোন সাফল্যের কথা ভাবছে? টাকা-পয়সা, নাম-যশ-ক্ষমতা, বাড়ি-গাড়ি অর্জনের সফলতা? মানুষের চোখে বড় হয়ে উঠার সফলতা? নাকি, মানুষকে শাসনের সফলতা?
এর কোনোটাই নয়। তারা সফলতা বলতে তাদের বাবা-মা'র টাকা-পয়সাকে বুঝেনি। তাদের পারিবারিক আভিজাত্যকে বুঝেনি। তাদের ক্ষমতার ব্যবহারকে তারা সফলতার মানদণ্ড বানায়নি। তাদের কাছে সফলতা ছিলো একটাই— অনন্ত আখিরাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালার প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া।
ধরা পড়ে যদি ঈমান হারাতে হয়, যদি উপাস্য হিশেবে গ্রহণ করতে হয় কোন মিথ্যা ইলাহকে, তাহলে সেই সফলতা যে তারা কোনোদিন লাভ করতে পারবে না, সেই ভয়েই তারা ভীত ছিলো সেদিন। পেছনে রেখে আসা সম্পদ, সম্পর্ক, স্মৃতি— কোনোটাই তাদের পিছুটান নয় কেবল ঈমান ছাড়া।
তারা তো সফলতা বলতে আল্লাহকে পাওয়াটাই বুঝেছে, প্রতিযোগিতার এই দুনিয়ায় আপনার-আমার কাছে সফলতা মানে কী?
No comments