বরবাদ | ১ম পর্ব | শামসুল আরেফীন শক্তি
ড. ইয়াসির কাদ্বী তাঁর জীবনে যতগুলো ভাল কাজ করেছেন, তার মাঝে একটা হল ২০১১ সালে তাঁর ১০৪ পর্বের ‘সীরাহ’ সিরিজ। সেসময়ের ইয়াসির কাদ্বী আর বর্তমানের ইয়াসির কাদ্বীর মাঝে আকাশ-পাতাল ফারাক। বর্তমানে কাউকে আমি ইয়াসির কাদ্বী শোনা বা পড়ার পরামর্শ দিই না। তবে আমি নিজে তাঁর জন্য দুআ করি, আল্লাহ যেন তাঁকে আবার আগের মত আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেন।
সীরাহ আলোচনায় তিনি ইসলামের দুশমনদেরকে ২ ভাগে ভাগ করেছিলেন— evil enemy (বদমাশ শত্রু) আর noble enemy (সম্ভ্রান্ত শত্রু)। আমরা ধারাবাহিকভাবে এদেরকে নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। এবং এইসব evil enemy আর noble enemy-দের পরিণতি কী হয়েছিল, কেন হয়েছিল। বর্তমান সময়ে আমরা এদের থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি, তা নিয়ে আলাপ করব ইনশাআল্লাহ।
------------------------------------
১ম পর্ব
আবু জাহল:
আসল নাম আমর ইবনে হিশাম। উপাধি ছিল ‘আবুল হাকাম’— জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, স্কলার। জানা যায়, সে মাটিতে কান লাগিয়ে বলতে পারত উট কতদূরে হাঁটছে, মাদী না মর্দ্দা। মক্কার লোকেরা নানান সমস্যায় তার কাছে যেত সমাধানের জন্য। এতো জ্ঞান এতো প্রজ্ঞা (insight) আল্লাহ তাকে দিয়েছেন, সে কি বুঝতে পারেনি, মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। সে কি বুঝতে পারেনি, সে কী করছে। তার জ্ঞান, তার বিবেক তাকে ঠিকই বলেছিল, ঠিকই চিনিয়ে দিয়েছিল— ইনিই আল্লাহর রাসূল।
একবার নবীজি কাবার চত্বরে দাওয়াত দিলেন। আবু জাহল নবিজি চলে গেলে মুগীরা ইবনে শোবা রা. এর দিকে চেয়ে বললো: খোদার কসম আমি জানি, তিনি যা বলছেন তা সত্য কথা। কিন্তু তাঁর কথা আমি এজন্য মানতে পারছি না কারণ তিনি কুসাই গোত্রের। কুসাইরা কাবার মুতাওয়াল্লি হয়েছে, হাজীদের পানি পান করানোর সম্মান পেয়েছে, পরামর্শ মজলিসের ব্যবস্থাপনার গৌরবও তাদের, যুদ্ধে ঝাণ্ডা বহনের ইযযতও তারা নিয়েছে। এখন মেহমানদারিতে আমরা কোনোমতে তাদের সমকক্ষ হয়েছি; আর এদিকে তারা আবার দাবি করছে তাদের ভিতর একজন নবী হয়েছে। খোদার কসম, আমি এটা জীবনেও মানবো না। [আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া সূত্রে হায়াতুস সাহাবা ১/১১১]
একই কথা আবু জাহল আখনাস বিন শারীক-কেও বলেছে: আমরা মর্যাদা ও সম্মানে বনু আবদে মানাফের সাথে (নবীজীর বংশ) সবকিছুতে প্রতিযোগিতা করেছি। তারা মেহমানদারি করেছে, আমরাও করেছি। তারা দান-খয়রাত করেছে, আমরাও করেছি। তারা লোকেদের সেবাযত্ন করেছে, আমরাও করেছি। সমান না হওয়া অব্দি আমরা এসব করতে থেকেছি। আর এখন তারা বলছে, তাদের মাঝে আকাশ থেকে ওহী-পাওয়া নবী এসেছে? আমরা এখন কীভাবে এর সমান হব? আল্লাহর কসম, আমরা জীবনেও তার কথা বিশ্বাস করব না, তার আনা সংবাদ মানবো না।
আবু জাহল ছিল মাখযূম গোত্রের, ইয়াকজা বিন মুররার সন্তানদের গুষ্টি। নবীজি ছিলেন কুসাই বিন কিলাব বিন মুররার গোত্রের। আবু জাহলের মধ্যে ছিল নেতৃত্বের মোহ, বংশের গৌরব, নবীর বংশের প্রতি অন্ধশত্রুতা ও হিংসা। যা তাকে হেদায়েত পেতে দেয়নি।
শত্রুতার নানান ধরণ আছে। কিছু শত্রু আছে, যাদের শত্রুতার মাঝেও আর্ট আছে। আর কিছু শত্রুর শত্রুতা ছ্যাঁচড়ামি ছাড়া আর কিছু না। একদিন নবীজি কাবার পাশে সালাত আদায় করছিলেন। পাশেই কুরাইশদের কয়েকজন নেতা বসা। আবু জাহল এসে তাদের উদ্দেশ্যে বললো: অমুক একটা উট জবাই করেছে। কে ওটার নাড়িভুড়ি এনে মুহাম্মদের মাথায় ঢালতে পারবে?’ দেখেন, কোন পর্যায়ের ছ্যাঁচড়ামি আর ছোটোলোকি। শত্রুতার কেমন ধরন তার মাথায় এসেছে। উকবা ইবনে আবী মুইত হতভাগা গিয়ে কাজটা করে ফেলল, তাকে নিয়ে পরে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। [সহীহ বুখারী]
আরেকদিন এসে নেতাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলছে: ‘আজকাল তোমরা মুহাম্মদকে মাটিতে মুখ ঘষাঘষি করার (নামায পড়ার) সুযোগ দিচ্ছো? আমি যদি তাকে এমন করতে দেখি, তাহলে গলায় পাড়া দিয়ে মুখটা ধুলোয় ঘষে দেব’। আরেকদিন বললো কী— ‘আল্লাহ সাক্ষী, কাল আমি ভারী একটা পাথর নিয়ে অপেক্ষা করব, সে (নবীজী) সেজদায় গেলেই তার মাথা গুঁড়ো করে দেব। তোমরা আমার পাশে থাকো আর না-ই থাকো, আর বনু আবদে মানাফ আমাকে যা ইচ্ছে তা করুক পারলে। শত্রুতার লেভেল দেখেন। সে জানে নবীজি যা বলছেন, সত্য বলছেন। তারপরও শত্রুতার ধরন দেখেন। শত্রুতার ভিতরেও মহানুভবতা আছে, ইনসাফ আছে। কিন্তু আবু জাহলের শত্রুতার ভিতরে আছে নোংরামি আর ইতরামি। আমাদের মুসলিমদের ভিতরেও এমন বৈশিষ্ট্যের লোক আছে, ভিন্নমতের মুসলিমদের প্রতি এমন মনোভাব রাখে।
আরও কী করত শোনেন। ইরাশ গোত্রের এক লোক মক্কায় এসে নালিশ দিল: আবু জাহল তার থেকে কিছু উট কিনে টাকা দেয়না, খালি ঘুরায়। খাসলতগুলো লক্ষ্য করেন। ঠগ, ফ্রড, জোচ্চোর যাকে বলে। লোকেরা তামাশা দেখার আশায় তাকে বলল: তুমি মুহাম্মদের কাছে যাও, সে আদায় করে দেবে।
চাচাতো ভাই আইয়াশ বিন আবী রবীয়াকে মদীনা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য কাহিনী বানিয়েছে: আইয়াশ ফিরে আসো, তোমার মা তুমি না এলে ছায়ায় যাবে না, রোদে দাঁড়িয়ে আছে। চুলও আঁচড়াবে না। এই মিছে কথাটুকু বলার জন্য ৪০০ কিলো সফর করেছে মদীনায়। স্ট্যামিনা দেখেন। কী পরিমাণ ডেডিকেটেড বদমায়েশ। আমার আপনার দ্বারা সম্ভব মিথ্যে কথা বলার জন্য, কোনো লাভ ছাড়া ৪০০ কিলো রোদের মাঝে উটের পিঠে?
এ ছাড়া নবীজীকে হত্যা করার পরিকল্পনা এবং নবীজীকে জীবিত বা মৃত ধরে আনার জন্য ১০০ উট পুরস্কার ঘোষণাও আবু জাহলই করেছিল। আর এটাই ছিল শত্রু হিসেবে তার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য স্টেপ। একজন শত্রু আমাকে হত্যা করতে চাইবে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু শত্রুতা করতে গিয়ে আর যা যা সে করেছে, তা সবই নিকৃষ্ট ছোটোলোকি ও ইতর প্রকৃতির।
ইবনে ইসহাকের বর্ণনায়: সম্ভ্রান্ত কেউ মুসলিম হলে আবু জাহল দেখে নেয়ার হুমকি দিত। ব্যবসায়ী কেউ মুসলিম হলে তাকে বয়কট করত। আর নিঃস্ব কেউ মুসলিম হলে নিজেও মারধর করত, অন্যদেরকেও মারার জন্য ডেকে আনতো। আম্মার রা. এর পিতা ইয়াসির ও মাতা সুমাইয়া রা. শহীদ হন এই আবু জাহলের হাতে। এক বর্ণনায়, সুমাইয়া রা. এর লজ্জাস্থানে বর্শা মেরে শহীদ করে জানোয়ারটা। লেভেল দেখেন। কোনো লেভেল-ছাড়া। উত্তপ্ত বালুর উপরে পাথর চাপা দিয়ে রাখা ছিল আবু জাহলের শখের মত। নিজের দাসী হারিসা বিনতে মুয়াম্মিলের চোখই নষ্ট করে দিয়েছিল পিটিয়ে।
আর নবীজীর সাথে দুর্ব্যবহারের কথা কত বলব। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সে অপমান অপদস্থ করত, গালাগালি করত, টিটকারি-বিদ্রুপ করত। একবার এসব করার জন্য নবীজীর চাচা হামযা রা. সবার সামনে আবু জাহলকে উত্তম-মধ্যম দিয়েছিলেন। তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা পালটা একশন নিতে চাইলে আবু জাহল নিজেই ঠেকায়: বাদ দাও, আজ আসলেই মুহাম্মদকে অনেক বেশি কথা শুনিয়েছি। কারও ব্যক্তিত্ব-বিশ্বাস নিয়ে বিদ্রূপ-ব্যঙ্গ-ট্রল এগুলো শত্রুতার চূড়ান্ত ইতর-টাইপ হাতিয়ার। বদর যুদ্ধে বের হবার টাইমে আয-যুহফা যুহাইম সকলকে নিষেধ করছিল যাবার জন্য; আবু জেহেল বিদ্রূপ ছুঁড়ে দিল: ‘এহ, আইছে আরেক নবী বনু মুত্তালিবের বংশে; সব জানে কাল কী হবে না হবে’। আল্লাহ যখন কুরআনে যাক্কুমের কথা বললেন, তার প্রতিক্রিয়া ছিল: ‘আরে, তোমরা জানো যাক্কুম কী? যাক্কুম হল মদীনার মাখনে ডোবানো খেজুর। পেলে গপাগপ শুধু গিলবে, বুঝলে?’ আবার দেখেন আল্লাহর সাথেও মশকরা করে, ‘ও আল্লাহ, যদি এই কিতাব আসলেই আপনার তরফ থেকে এসে থাকে, তাহলে আমাদের উপর পাথর বর্ষণ করুন, কিংবা ভয়ানক কোনো আযাব দিন’। অথচ সে কিন্তু জানে, নবীজী যা বলছে সত্য বলছে। শুধু বংশের অহমিকায় অন্ধ হয়ে সে কত কিছু বলে ফেলছে। আজ দেখবেন অনেক মুসলিম নামধারীও দলের জন্য, চেতনার নামে, দলীয় মতাদর্শে অন্ধ হয়ে এমন অনেক কথা বলে ফেলে। সে নিজের সীমাও বোঝেনা। সে বোঝেনা কখন থামতে হবে। ইবনে মাসউদ রা. এর হাতে কতল হবার আগে আবু জাহল বলেছিল: আমার গলাটা একটু লম্বা করে কেটো, যেন মানুষ বোঝে এটা সর্দারের মাথা৷
আবু জাহল নেতৃত্ব (পোস্ট-পজিশন) ছেড়ে আসতে পারেনি। বংশের (পড়ুন দলের) চেয়ে বেশি প্রাধান্য সত্যকে দিতে পারেনি। সে জানে কোনোটা সত্য, কিন্তু সে পোস্ট ও দলের চেয়ে আল্লাহ-রাসূল-দীন কে আগে রাখতে পারেনি। আমি পারবো তো?
তাই নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন দুআ করেছেন: ‘আল্লাহ, দুই উমরের একজনকে হেদায়াত দিয়ে দীনকে শক্তিশালী করুন। হয় উমর ইবন খাত্তাব, নয়তো আমর ইবনে হিশাম (আবু জাহল)’। আল্লাহ আবু জাহলকে কবুল করেননি। এই খাসলতের লোক মুসলিম হলেও ইসলামের ক্ষতি।
আমার সাথে কোনোভাবে, কোনোপ্রকারে, কোনো-এঙ্গেলে আবু জাহলের মিল নেই তো?
No comments