পূর্বাহ্নের সূর্যকিরণ | সূরা আদ-দূহা | অনুপ্রেরণার কথামালা
পূর্বাহ্নের সূর্যকিরণ।
.
কুরআনে আমার পঠিত সবচে' অনুপ্রেরণাদায়ক সূরাহ হল 'সূরা আদ-দুহা'। রাব্বুল ইজ্জাত ওয়া জালাল ছোট ছোট মোট ১১টি আয়াতে চমৎকার বার্তা দিয়েছেন। প্রতিটি আয়াতের ভাঁজে ভাঁজে আপনি খুঁজে পাবেন অনুপ্রেরণা। আসলে কুরআন যে পৃথিবীর সব থেকে প্রাচীন এবং সুন্দর মোটিভেশনাল বই আমরা তা ভুলে গিয়েছি। আমরা ঘেটে দেখি না, মহান রব্ব আমাদের কি কি নির্দেশ দিয়েছেন।
.
সূরাহ আদ-দুহা হল একটি পূর্ণাঙ্গ অনুপ্রেরণাদায়ক দিকনির্দেশক। এক বসাতে সূরাটির তাফসীর নয় শুধু বঙ্গানুবাদ পড়লেই আপনি ফিরে পাবেন এক অদম্য শক্তি (ইন শা আল্লাহ)। সূরাটি নাযিল হবার পূর্বকথা কিংবা শানে নুযূলও খুব উৎসাহ মূলক বার্তা বহন করে। এতে ভগ্ন হৃদয়ের বান্দাদের জন্য আশার বাণী দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ আযযা ওয়া জাল।
.
একবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু' আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেশকিছুদিন ওঁনার কাছে ওহী আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তিনি নতুন কোন বাণী ইসলাম গ্রহণ করা সাহাবে কিরামদের (রাদিআল্লাহু আনহুমা) শুনাতে পারছিলেন না। বিষয়টি বুঝতে পেরে তৎকালীন মুশরিকরা বলাবলি করতে শুরু করলো, 'তোমার রব্ব তোমাকে পরিত্যাগ করেছে'।
.
এক মহিলা তো রাসূলুল্লাহকে কষ্ট দিতে বলে দিল, 'তোমার কাছে যে শয়তানটা আসতো সে বুঝি তোমাকে ভুলে গিয়েছে?' (নাউজুবিল্লাহ)। চতুর্মুখী আক্রমণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু' আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হৃদয় ভেঙে যায়, তিনি কষ্ট পান। তখন কাফের, মুশরিকদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ জিব্রাইল (আলাইহিস সালম) এর মাধ্যমে আয়াত নাযিল করেন।
.
সূরাহ আদ-দুহা এর প্রথম তিন আয়াত। আয়াতগুলো..
.
وَ الضُّحٰی ۙ﴿۱﴾
১. কসম পূর্বাহ্নের,
وَ الَّیۡلِ اِذَا سَجٰی ۙ﴿۲﴾
২. কসম রাতের যখন তা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়।
مَا وَدَّعَکَ رَبُّکَ وَ مَا قَلٰی ؕ﴿۳﴾
৩. তোমার রব তোমাকে পরিত্যাগ করেননি এবং অসন্তুষ্টও হননি।
.
সূরাটির প্রথম আয়াতের সাথে মিল রেখে নামকরণ করা হয়েছে 'আদ-দুহা' মানে পূর্বাহ্নের সূর্যকিরণ। পবিত্র কুরআনে মহান রব্ব অনেক বিষয়ের কসম করেছেন। কিন্তু প্রতিক্ষেত্রে এই কসম কিংবা শপথ করার পেছনের কারণটা হচ্ছে, তিনি যদি কোন বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করতে চান তবেই শপথের কথা উল্লেখ করেন। আমরা সাধারণত কোন বিষয় বা বস্তুর উপর কসম বা শপথ নিতে পারি না। কিন্তু আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা পারেন, তিনি স্রষ্টা। তাঁর সৃষ্টিকূলের যেকোন বিষয়ের উপর তিনি শপথ করতে পারেন। এটাই রব্বানীয়্যাত।
.
আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা একটা সময়কে বেছে নিলেন শপথের জন্য, সেটা সূর্যোদয়ের সময়। আল্লাহ হয়তো তার রাসূলকে আশার আলোর নিদর্শন দিতে প্রথমে পশ্চিমাকাশে সূর্যের উদয়কে বুঝিয়েছেন।
.
দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ রাতের কসম করেছেন। দিন-রাত সবকিছু আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা'র নির্দেশেই হয়ে থাকে। তিনি বলেন,
.
“(তিনি) প্রভাত উদ্ভাসক। তিনি বানিয়েছেন রাতকে প্রশান্তি এবং সূর্য ও চন্দ্রকে সময় নিরূপক। এটা সর্বজ্ঞ পরাক্রমশালীর নির্ধারণ।” (সূরাহ আল-আন'আম : ৯৬)
.
প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে দয়াময় আল্লাহ তাঁর অগণিত সৃষ্টির কিছু নির্দশন বলেছেন। অতপর তিনি তাদের (কাফের, মুশরিকদের) প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
.
আপনার রব্ব আপনাকে ভুলে যায়নি, আপনাকে পরিত্যাগও করেনি। তার মানে এই আয়াতে আল্লাহ, রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু' আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভরসা দিচ্ছেন। আপনি তাদের কথায় মন খারাপ করবেন না, ব্যথিত হবেন না, কষ্টও পাবেন না।
.
পৃথিবী আপনার স্থায়ী ঠিকানা নাঃ
.
وَ لَلۡاٰخِرَۃُ خَیۡرٌ لَّکَ مِنَ الۡاُوۡلٰی ؕ﴿۴﴾
৪. আর অবশ্যই তোমার জন্য পরবর্তী সময় পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে উত্তম।
.
রাসূল (সাল্লাল্লাহু' আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে আল্লাহ পাঠিয়েছিলেন একটা উদ্দ্যেশে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু' আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনোই দুনিয়ার জীবনকে আপন করে নেননি। ওঁনার জীবদ্দশায় তিনি খেজুরের চাটাইয়ে ঘুমিয়েছিলেন, একটি খাট কিংবা বিছানার প্রত্যাশা করেনি। এই আয়তে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এই দুনিয়াতে তুমি সুখ তালাশ করো না। এখানে সুখ পাওয়া যাবে না, সুখের ঠিকানা জান্নাত! সুতরাং, দ্বীন প্রচার করতে গিয়ে আপনাকে তিরষ্কার সইতে হবে, বিনিময়ে জান্নাতে অপার নিয়ামত অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।
.
নিয়ামতের প্রতিশ্রুতিঃ
.
وَ لَسَوۡفَ یُعۡطِیۡکَ رَبُّکَ فَتَرۡضٰی ؕ﴿۵﴾
৫. আর অচিরেই তোমার রব তোমাকে দান করবেন, ফলে তুমি সন্তুষ্ট হবে।
.
এই আয়াতে রাব্বুল আলামীন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে খুশি করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আখেরাতে আপনাকে হাউজে কাওসার দান করা হবে। আপনার গোনাহগার অগণিত উম্মতকে শাফা'আত করার সুযোগ দেয়া হবে। যাদের বেশিরভাগকে আপনি না দেখে ভালোবাসেন, তারাও আপনাকে না দেখেই ভালোবাসে। আপনি ওগুলো মনে করুন। কষ্ট পাবেন না। দুনিয়ার জীবনের কষ্টের বিনিময়ে মহান রব্ব আপনাকে অনেক বেশি নিয়ামত দান করেন।
.
কিছু স্মরণিকাঃ
.
اَلَمۡ یَجِدۡکَ یَتِیۡمًا فَاٰوٰی ۪﴿۶﴾
৬. তিনি কি তোমাকে ইয়াতীম অবস্থায় পাননি? অতঃপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন।
.
وَ وَجَدَکَ ضَآلًّا فَہَدٰی ۪﴿۷﴾
৭. আর তিনি তোমাকে পেয়েছেন পথ না জানা অবস্থায়। অতঃপর তিনি পথনির্দেশ দিয়েছেন।
.
وَ وَجَدَکَ عَآئِلًا فَاَغۡنٰی ؕ﴿۸﴾
৮. তিনি তোমাকে পেয়েছেন নিঃস্ব। অতঃপর তিনি সমৃদ্ধ করেছেন।
.
এই তিনটি আয়াতে আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু' আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে দুনিয়াতে দেয়া উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। তিনি ছিলেন ইয়াতীম, শৈশবেই বাবা-মা হারিয়েছিলেন। বাবা-মা বিহীন তাদের স্নেহ বিহীন শৈশবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু' আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সঙ্গী করে দিয়ে ছিলেন তার স্বীয় দাদা আব্দুল মুত্তালিবকে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বয়স যখন আট তখন ওঁনার দাদাও বিদায় হলেন, তখন ওঁনাকে সঙ্গী করে দিয়ে ছিলেন চাচা আবু তালেবকে। এভাবে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা তাঁর হাবীবের একাকীত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন।
.
এরপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু' আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে নবুয়ত দান করার মাধ্যমে পথ দেখালেন। আম্মাজান খাদিজাতুল কুবরা (রাদিআল্লাহু আনহা) কে জীবন সঙ্গী হিসেবে দান করে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করেছিলেন।
.
এভাবে কষ্টে নিমজ্জিত, ভগ্ন হৃদয়ের রাসূলকে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা খুশি করে দিলেন।
.
আল্লাহ'র অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতার দারসঃ
.
فَاَمَّا الۡیَتِیۡمَ فَلَا تَقۡہَرۡ ؕ﴿۹﴾
৯. সুতরাং তুমি ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হয়ো না।
.
وَ اَمَّا السَّآئِلَ فَلَا تَنۡہَرۡ ﴿ؕ۱۰﴾
১০. আর ভিক্ষুককে তুমি ধমক দিওনা।
.
وَ اَمَّا بِنِعۡمَۃِ رَبِّکَ فَحَدِّثۡ ﴿٪۱۱﴾
১০. আর তোমার রবের অনুগ্রহ তুমি বর্ণনা কর।
.
স্বীয় জীবনে প্রিয় নবী (সাল্লল্লাহু' আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন ইয়াতীম। সূরার এই অংশে এসে, আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা রাসূল (সাল্লাল্লাহু' আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে শিক্ষা দিচ্ছেন, আপনিও ইয়াতীম ছিলেন সুতরাং ইয়াতীমদের সাথে নরম আচরণ করুন।
.
একটা সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু' আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রচুর অভাবে ছিলেন, অনাহারে পেটে ভারী পাথর বেঁধে রাখতেন। তিনি জানেন, অভাব, ক্ষুধার যন্ত্রণা কী! আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন অভাবী, ভিক্ষুকদের সাথে আপনি ধমকের সুরে কথা বলবেন না। তাদের সাথে নম্র আচরণ প্রদর্শণ করুন।
.
সর্বশেষ, এতএত অনুগ্রহের কথা তিনি যেন স্মরণ রাখেন, সেগুলোর শুকরিয়া আদায় করেন। মূলত শেষের তিনটি আয়াত আল্লাহ আগের অনুগ্রহ কিংবা নিয়ামতের কথা স্মরণ করাতেই নাযিল করেছেন।
.
সূরাহ আদ-দুহা সবার পড়া উচিত। তা থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। জীবনের বাঁকে বাঁকে সুখ-দুঃখ লুকায়িত! আমাদের দুঃখের সময় সুখগুলো মনে করে আল্লাহ'র শুকরিয়া আদায় করা এবং সুখের সময় দুঃখের কথা মনে করে আল্লাহ'র শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
.
Centre theme of this Surah is 'Never lose your hope'
.
সূরাহ আদ-দুহার কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়, কখনো আশাহত হওয়া যাবে না।
.
রেফারেন্সঃ
.
তাফসীরে ইবনে কাসীর।
_____________________
পূর্বাহ্নের সূর্যকিরণ
//সিয়াম ভূঁইয়া//
.
.
No comments