ধৈর্য আর শান্ত থাকার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখালেন একজন অমুসলিম | পড়ুন আর শান্ত থাকার শিক্ষা নিন
সত্যি বলতে, আমরা রাজার হালে আছি, এমনকি আইসোলেশনের দিনগুলোতেও। আসুন, আলহামদুলিল্লাহ বলি। এবং অভিযোগ করার বদলে আল্লাহর প্রতি আমাদের লজ্জাকে জাগ্রত করি।
.
আল্লাহ বলেন,
مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ
'আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো বিপদ আসে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, আল্লাহ তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ সকল বিষয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।' [সূরা তাগাবুন, ৬৪: ১১]
.
এর ব্যাখ্যায় আলকামাহ (রহ.) বলেন,
هو الرجل تصيبه المصيبة فيعلم أنها من عند الله فيسلم لها ويرضى
'এ হলো সে ব্যক্তি, যে জানে তার ওপর মুসিবত এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। ফলে সে আত্মসমর্পণ করে এবং সন্তুষ্ট থাকে।’ [তাফসীরে তাবারী]
.
ওপরের আয়াতে ‘সঠিক পথে পরিচালিত করেন’ বাক্যটি আরবীতে এসেছে يَهْدِ ‘ইয়াহ-দি’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভিন্ন কেরাত অনুযায়ী—ইকরিমাহ (রহ.)-এর কেরাতে—এটি পড়া হতো ‘ইয়াহ-দা’, যার অর্থ ‘তার অন্তর প্রশান্তি খুঁজে পাবে।’ মোট কথা এখানে দুটো পুরষ্কারের কথা বলা হয়েছে:
.
হিদায়াত এবং অন্তরের প্রশান্তি।
.
এমনকি অমুসলিমদের ভিতর যারা মুসলিমদের সাথে সময় কাটিয়েছে, তারাও এর সাক্ষী হয়ে আছে। একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছিল, ‘The garden of Allah’, লেখক Colonel Ronald Bodley, একজন ব্রিটিশ আর্মি অফিসার, লেখক এবং সাংবাদিক। এই আর্টিকেলে তিনি সমগ্র বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন একটি ঘটনা বলে:
.
‘১৯১৮ সালের কথা, এতকাল আমি পৃথিবীকে যে চোখে দেখতাম, আমার চিন্তাধারা সমূলে পাল্টে গেল। উত্তর-পশ্চিমের আফ্রিকায় গিয়েছিলাম সে বছর। আরব মুসলিমদের সাথে সাহারায় ছিলাম। সেখানে ৭ বছর থেকেছি। শিখেছি বেদুইনদের ভাষা, পরেছি তাদের পোশাক। তাদের খাবার খেয়েছি, এভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম তাদের জীবন যাত্রার সাথে। আমি ভেড়ার মালিকও হয়ে যাই। আরবদের তাবুতে ঘুমতাম, তবে মাটিতে...’
.
এরপর তিনি বলেন, ‘রাখালদের সাথে কাটানো সেই সাতটি বছর ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে প্রশান্তির, সবচেয়ে আরামের। তারা জীবনকে একটি রশি দিয়ে বেঁধে নিয়েছিল, যার নাম শান্তি। কখনও তাড়াহুড়ো করত না তারা, অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে অযথা রেগে যেত না। তারা জানত, যা ঘটে, তা পূর্ব নির্ধারিত; এবং আল্লাহ ছাড়া কারও ক্ষমতা নেই এর রদবদল করার। তবে এর মানে এই নয়, ক্রান্তিকালে, সংকটের দিনে তারা হাত পা গুঁটিয়ে বসে থাকত, কিছু করত না। বিষয়টি বোঝার জন্য আপনাদের সাথে একটি ঘটনা শেয়ার করি:
.
সিরোক্ক নামক এক প্রকার জ্বালাময়ী বালুঝড় হয় সাহারায়। অত্যন্ত হিংস্র এই ঝড়। সাহারায় থাকতে আমি এর কবলে পড়ি। এর গর্জন, এর আর্তনাদ যেন থামার নয়, টানা তিনদিন অবিরাম চলতে থাকল। দিন নেই, রাত নেই। অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ভয়ঙ্কর এই ঝড়। এতটাই যে, সাহারার বালুকণা হাজার মাইল উড়িয়ে নিয়ে সে Mediterranean সমুদ্রে নিয়ে ফেলত এবং ফ্রান্সের Rhone উপত্যকায় ছড়িয়ে দিত। এর বাতাস প্রচণ্ড রকমের গরম, যেন আমার মাথার চুল জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে! আমার গলা শুঁকিয়ে আসছিল, চোখে ঝলসে গিয়েছিল, আর আমার দাঁত বালুকণায় ভরে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, আমি কোনো গ্লাস কারখানার হাপরের সামনে আমি দাঁড়িয়ে। নিজের মানসিকতা সুস্থ রেখে একজন মানুষ যতটা পাগলপ্রায় হতে পারে, আমার অবস্থা এরকম দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আরবদের মুখে কোনো অভিযোগ নেই, কোনো অস্থিরতার ছাপ নেই, যেন নিথর পাথর। তারা আমার কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলল, ‘মাকতূব’, অর্থাৎ যা হচ্ছে, এসব তাকদীরের লেখন।
.
কিন্তু ঝড় শান্ত হতেই তাৎক্ষণিক তারা কাজে নেমে পড়ে। ভেড়ার বাচ্চাগুলো যবেহ করল, কারণ, তারা জানত এরা বাঁচবে না। যবেহ শেষ হলে এগুলো পানি দিয়ে ধুতে দক্ষিণাভিমুখে নিয়ে যায়। আর এসব তারা করছিল শান্ত মনে, কোনো উদ্বেগ নেই, নেই কোনো উৎকণ্ঠা। বিনা অভিযোগে তারা এসব করে যাচ্ছিল। হারানো বস্তু নিয়েও হাহুতাশ নেই। গোত্রপ্রধান বললেন, “পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারত। হ্যাঁ, আমরা সব কিছু হারিয়েছি, তবুও আলহামদুলিল্লাহ। নতুনভাবে শুরু করার জন্য এখনও আমাদের চল্লিশ ভাগ ভেড়া রয়েছে।”’
.
Colonel Ronald বলল, ‘আমার আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। আমরা তখন মরুভূমিতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটি টায়ার ফেটে যায়। এই দিকে ড্রাইভার অতিরিক্ত টায়ার আনতে ভুলে গেছে। মোট কথা গাড়ির চাকায় এখন মাত্র ৩টি টায়ার। আমি হৈচৈ শুরু করলাম, উত্তেজিত হয়ে গেলাম। “এখন আমরা কী করব?” জানতে চাইলাম আরবদের কাছে। তারা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলল, উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, বরং এই উত্তেজনা স্রেফ ব্যক্তিকে এই মরুভূমিতে আরও গরম করে তুলবে। টায়ারগুলোর পাম তারা ছেড়ে দিল এবং বলল, “আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করার নেই।” তারপর আমরা টায়ার ছাড়াই চলতে শুরু করলাম। একটা পর্যায় গাড়ি থেমে গেল। পেট্রোল শেষ। গোত্রপ্রধান আবার স্মরণ করিয়ে দিল, “মাকতূব!” কেউ কিছু বলল না, ড্রাইভার কেন অতিরিক্ত পেট্রোল নিয়ে বের হলো না—এ নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি না করে সবাই শান্ত রইলাম এবং বেদুইনদের গান গাইতে গাইতে আমরা হাঁটা ধরলাম গন্তব্যের দিকে।
.
বেদুইন আরবদের সাথে কাটানো এই সাতটি বছর আমাকে হারে হারে বুঝিয়ে দিয়েছে, আজকের ইউরোপ আমেরিকার এই বাতুলতা, উন্মাদনা এবং নেশাগ্রস্ত জীবনের মূল কারণ অস্থিরতা, গোলমেলে জীবনব্যবস্থা, যাকে আমরা নাম দিয়েছি সভ্যতা! এই তথাকথিত সভ্যতাই দায়ী।
.
যতদিন সাহারায় ছিলাম, আমার কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। আমি সেখানে, আল্লাহর সেই বাগানে পেয়েছিলাম একটি নির্মল প্রশান্ত জীবন; এমন সুস্থ জীবন, যার খোঁজে আমরা অনেকেই পেরেশান।’
.
পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, ১৯১৮ সালে যখন Colonel Ronald উত্তর আফ্রিকায় যান, তখন Spanish Flu নামক মহামারী ছড়িয়ে পড়েছিল। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১ কোটি ৭০ লক্ষ থেকে ৫ কোটির মতো। উত্তর আফ্রিকায় এই মহামারী ছড়ায় নি; তথাপি দেখুন, যখন ইসলাম সঠিকভাবে পালন করা হয়, তখন আমাদের মানসিকতায় কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
.
আসুন, এই শিক্ষা আমরা সদা স্মরণ রাখি। যখনই আমরা COVID 19 এর মতো কোনো মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি শুনছি কিংবা লক ডাউন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, আমরা এই শিক্ষাকে সামনে রাখি।
.
‘আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল’
‘সকল পরিস্থিতিতে যাবতীয় প্রশংসা শুধু আল্লাহর’
‘মাকতূব!’
.
.
—উস্তাদ আলী হাম্মুদা
অনুবাদ: মহিউদ্দিন রূপম
No comments