Header Ads

Header ADS

নারীবাদী, নারীমুক্তি, নারাস্বাধীনতা এসব আসলে কি?

নারীকে নিয়ে ইসলামের অবস্থান আর পশ্চিমের অবস্থানের মধ্যেকার সংঘর্ষ কারো সামনে  স্পষ্ট হয়ে যাবার পর কী হয়? এমন অবস্থায় কয়েক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। একটা হল উগ্র ‘নারীবাদী’ অবস্থান। যারা মোটাদাগে বাংলাদেশের শাহবাগী-‘মুক্তমনা’ ক্যাম্পের অংশ। এই ক্যাম্পের লোকজন অনবরত ইসলামকে আক্রমণ করে যায়। তাদের মতে সমাধান হল জীবনের সব বলয় থেকে ইসলামকে সরিয়ে দেয়া। 
.
দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়াটা সম্ভবত অধিকাংশ বাঙ্গালীর অবস্থান। এই বাঙ্গালী ইসলামের বিরোধিতা করে না। ধর্মভীরু মুসলিম বলে নিজের পরিচয় দেয়। কিন্তু নারীর সাথে যুক্ত ইসলামের অধিকাংশ বিধিবিধান সে মানে না। বাঙ্গালী কালচার, সমাজের ধারা, কিংবা অন্য কিছুর অজুহাত দিয়ে সে পিছলে বেরিয়ে যেতে চায়। সে ইসলামও মানে আবার পুরোপুরি ‘মুক্তমনা’ও না। সে দুটোর সুবিধাবী মিশ্রণ। এ ধরনের মানুষের কাছ থেকেই শোনা যায়, ‘মনের পর্দা বড় পর্দা’, ‘ইসলাম তো অতো কঠিন না’, ‘বিশ্বাস, ভক্তি তো অন্তরের বিষয়,’ ‘আমি প্রেম করছি কিন্তু আমার মন পরিষ্কার’, অথবা ‘বোরখা করে অমুক অমুক জায়গায় অমুক অমুক অপরাধ করা হয়েছে, এর চেয়ে বরং আমরাই ভালো আছি বাবা!’। 
.
দীর্ঘ একটা সময় জুড়ে এ দুটোই ছিল প্রধান অবস্থান। কিন্তু বর্তমানে, গত প্রায় পনেরো-বিশ বছর ধরে অ্যামেরিকার ‘মডারেট ইসলাম’ প্রকল্পের ফসল হিসেবে তৃতীয় এক ধরনের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এ প্রতিক্রিয়াটা হল রিভিশনিস্ট, রিফর্মিস্ট এবং ‘মুসলিম’ ফেমিনিস্টদের অবস্থান। মর্ডানিস্ট এবং অ্যামেরিকার পছন্দের ‘মডারেট’ মুসলিমদের অবস্থান। সহজ ভাষায় এ অবস্থানটা হল পশ্চিমের সাথে খাপ খাওয়ানোর। নারীর ব্যাপারে ইসলামের যে অবস্থানটা পশ্চিমের সাথে সাংঘর্ষিক সেটাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার। এই ‘ব্যাখ্যার’ তোড়ে হিজাব হয়ে যাচ্ছে ‘ব্যাক্তি স্বাধীনতা’,  নারীর ঘরের বাইরে অবস্থান সংক্রান্ত পুরো ফিকহ হয়ে যাচ্ছে ‘ইজতিহাদি’ এবং ‘ইখতিলাফি’। আর পশ্চিমা ধাঁচের নারীর ক্ষমতায়ন আর নারী মুক্তির উদাহরণ খোঁজা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সীরাহ-তে। 
.
যেমন ‘ক্যারিয়ার ওম্যান’-এর উদাহরণ হিসেবে খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর উদাহরণ দেয়া হয়। তিনি সিইও ছিলেন, আন্ট্রাপ্রনোর ছিলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর উদাহরণ আজকের যুগে ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে আদৌ প্রযোজ্য কি না সেটা নিয়ে লম্বা আলোচনা করা সম্ভব। কিন্তু সে আলোচনা যদি আমরা বাদও দেই তাহলেও প্রশ্ন থাকে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মোট ১১ জন স্ত্রী ছিলেন। বাকি ১০ জন তো ব্যবসা করেননি। চাকরি করেননি। তাঁরা ঘরের ভেতরে জীবন কাটিয়েছেন। কেন ১০ জনকে ছেড়ে ১ জনের নবুওয়্যাতের জীবনের আগের উদাহরণকে এতো শক্ত করে আকড়ে ধরা?  
.
আবার ইসলাম নারীর ক্ষমতায়ন করেছে, এটা প্রমাণ করতে গিয়ে অনেকে ইসলামের ইতিহাসের নারী আলিমদের কথা বলেন। উদাহরণ হিসেবে তাঁদেরকে দাড় করিয়ে বলেন আজ মুসলিম নারীদের উচিৎ দলে দলে ঘর থেকে কর্মক্ষেত্রে বেরিয়ে আসা। কিন্তু এই আলিমাগণ কি মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসের অধিকাংশ নারীর অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করেন? প্রায় সাড়ে চৌদ্দশো বছরের ইতিহাসে কতো শতাংশ মুসলিম নারী আলিম হবার চেষ্টা করেছেন, আর কতো শতাংশ মা ও স্ত্রী হিসেবে ঘরে সময় দিয়েছেন? নাম না জানা যে কোটি কোটি মুসলিমাহ শরীয়াহর বিধান অনুযায়ী মা ও স্ত্রী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। উলামা ও মুজাহিদিন জন্ম দিয়েছেন, গড়ে তুলেছেন -  তাঁরা কি সবাই ব্যর্থ? নির্যাতিত? পুরুষতন্ত্রের শিকার? এ প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয় না। 
.
পশ্চিমা অর্থে ‘নারী শিক্ষা’র উদাহরণ হিসেবে আ’ইশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এবং ইসলামী ইতিহাসের অন্যান্য মুহাদ্দিসাদের (হাদীস বিশারদ) কথা বলা হয়। যে মহান নারীদের উদাহরণ দেয়া হচ্ছে তাঁরা কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করেছেন। তাঁরা ইলম অর্জন করেছিলেন। ইলম আর আজ ‘শিক্ষা’ বলতে আমরা যা বুঝি, তা এক না। দুটোর মধ্যে আছে অনেক, অনেক পার্থক্য। এই ইলম অর্জনের কাজটা তাঁরা করেছিলেন পর্দা, মাহরাম, ঘরের ভেতরের দায়িত্ব, নারী পুরুষের মেলামশা সংক্রান্ত ইসলামের সব বিধান মেনে। সেটা আজ সম্ভব কি না, তা নিয়ে কিন্তু কথা বলা হয় না। 
.
আ’ইশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তাঁর স্বামী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছ থেকে শোনা হাদীস বর্ণনা করেছেন। এর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশিওলজি পড়া, কিংবা হায়ার স্টাডিসের জন্য অস্ট্রেলিয়া কিংবা 'দ্বীন শিখতে' অ্যামেরিকা যাওয়ার ক্বিয়াস সূস্থ মস্তিষ্কে কিভাবে করা যায় না সেটাও খুব কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
.
সীরাহ এবং ইসলামী ইতিহাস থেকে বেছে বেছে কিছু তথ্য নিয়ে মুখস্থ অংকের উত্তর মেলানোর জন্য সেগুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে তুলে ধরা হয়। ইসলামকে ব্যাখ্যা করা হয় পশ্চিমা ছাঁচে। এভাবে ইসলামকে ‘রক্ষা’ করতে গিয়ে বিকৃত করা হয় ইসলামকে। প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়, পশ্চিম যে নারী শিক্ষা আর ক্ষমতায়নের কথা বলছে সেটা ইসলামে আরো আগে থেকেই আছে। অথচ বাস্তবতা হল পশ্চিমা প্যারাডাইম যেভাবে নারীর পরিচয় ও ভূমিকাকে সংজ্ঞায়িত করে, ইসলাম সেভাবে করে না। ইসলামে নারীর মূল দায়িত্ব, ভূমিকা এবং অবস্থান তাঁর ঘরে। পশ্চিমা নারীবাদের অবস্থান থেকে কোন ভাবেই এটাকে মেনে নেয়া সম্ভব না।  ইসলামে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা ভূমিকা ঠিক করে দেয়া হয়েছে। তাঁরা একে অপরের প্রতিযোগী না, তাঁরা একে অপরের সমান না, বরং তাঁরা একে অপরের পরিপূরক। 
.
এভাবে এক দল ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করছে, আরেক দল মুসলিম হবার কথা বললেও ইসলামের কিছু বিধিবিধান সারাজীবন উপেক্ষা করে যাচ্ছে, আরেক দল ইসলামের নতুন ব্যাখ্য তৈরি করছে পশ্চিমের আদলে। এ তিন প্রতিক্রিয়ার পেছনে মূল কারণ নারীর প্রশ্নে ইসলামের অবস্থানকে মেনে নিতে না পারা। তিন প্রতিক্রিয়াই চোখে শক্ত করে আঁটা পশ্চিমা লেন্সের ফসল।

©আসিফ আদনান

No comments

Powered by Blogger.