হতাশ? জীবনের আসল মানে খুঁজে পাচ্ছোনা? পড়
স্কুল লাইফে সবসময় প্রথম হতাম। ভালো ছাত্রের তকমা বলতে যা বোঝায় সেটাও ছিল। স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে যা হয় পরিবার, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবার একটা বিশাল প্রত্যাশার চাপ থাকে। প্রতিবার নতুন ক্লাসে উঠলে কার রোল কত হয়েছে এসব নিয়ে সবাই আলোচনা করত, কিন্তু আমাকে নিয়ে কোনো আলোচনা হতো না, কারণ সবাই ধরেই নিত আমি প্রথম। এর ফলে যা হতো-- প্রচন্ড এক প্রত্যাশার চাপ থাকত সবসময়। স্কুল জীবনের প্রায় সব পরীক্ষাই আমি দিতাম গায়ে জ্বর নিয়ে। টেনসনের জ্বর, প্রথম স্থান থেকে সরে গেলে কি করে মুখ দেখাব এই টেনশন।
পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে গেল কলেজে উঠে। লেখাপড়া বলতে গেলে একেবারে ছেড়েই দিয়েছিলাম। আমি আর আমার আরেক স্কুল ফ্রেন্ড, সবসময় একসাথে থাকতাম, ঘুরতাম, একসাথে কলেজ ফাঁকি দিতাম, একসাথে ফার্স্ট ইয়ারে ফিজিক্সে ফেল করলাম। বলা যায় একসাথে গোল্লায় গেলাম। এইচএসসিতে দুইজনই এ+ পেলাম না, খুবই স্বাভাবিক। আমি পেয়েছিলাম 4.80 আর আমার বন্ধু পেয়েছিল 4.70। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমরা দুইজন এই রেজাল্ট নিয়েও মেডিকেল ভর্তির কোচিং শুরু করলাম। প্রথম বার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় আমি প্রশ্নটাই ভালো করে বুঝিনি (সিরিয়াসলি)। আমরা দুইজন চান্স পাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসেনা। সবাইকে দ্বিতীয়বার অবাক করে দিয়ে আমরা দুইজন আবার মেডিকেলে পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলাম। এইবার আরেকটা কোচিং সেন্টারে (হাওয়া বদল বলতে যা বোঝায় আর কি :) )। আমার বন্ধু জোরেসোরে পড়াশোনা শুরু করল। আমাকে আকাশ থেকে মাটিতে পড়ার মতো বিস্ময় উপহার দিয়ে সে মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেল, ইন্টারে 4.70 রেজাল্ট নিয়েও। আমি এবারেও চান্স পেলাম না।
খুবই কঠিন দিন ছিল সেসময়। আমার চান্স না পাওয়ার চেয়ে আমার জন্য সবকিছু কঠিন হয়ে গিয়েছিল আমার বন্ধু চান্স পাওয়ায় (টিপিক্যাল মনুষ্য ফিতরাত)। এদিকে আমি ভার্সিটির জন্যও কোনো প্রস্তুতি নিইনি। জাহাঙ্গীরনগরে একটা ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম, সিরিয়াল আসলো, তবে হাজারের বাইরে (আমার বন্ধু এমনে আমার সাথে ঘুরতে এসেছিল, সে তিনশো সিরিয়ালে চলে আসল, মেজাজ গেল আরো চটে)। একেকটা দিন যে কী কঠিন আর অসহায় মনে হচ্ছিল! ঢাকা ভার্সিটির ঘ ইউনিটে পরীক্ষা সামনে, সময় ছিল মেবি আঠার কি বিশ দিন। কলেজ আর ভর্তি পরীক্ষা মিলে পড়াশোনা বলতে যা বোঝায় তা করেছিলাম এই কয়দিনেই। তবে পরিস্থিতি আরো কঠিন করে দিয়ে আমার পরীক্ষা খারাপ হয়ে গেল। প্রায় নিশ্চিত ছিলাম বাংলায় ফেল করব। আশা আরো ছেড়ে দিলাম যখন শুনলাম পরীক্ষার্থী ছিল চুয়াত্তর হাজার। অসহায়ের মতো ঢাকা ছেড়ে বাড়ী চলে আসলাম। কয়দিন পর রেজাল্ট দিল। আরেকবার আকাশ থেকে মাটিতে পড়ার মতো বিস্ময় নিয়ে চান্স পেয়ে গেলাম। তাও তিনশো প্লাস সিরিয়াল নিয়ে।
অনেক সময় নিয়ে নিজের ইতিহাস বর্ণনা করলাম। গতকাল এইচ এস সির স্যার রেজাল্ট দিয়েছে। যে ছেলেগুলো এ+ পায়নি আমি জানি এদের কি অবস্থা। এদের অবস্থা আরো ভয়াবহ হবে যখন এরা কোথাও চান্স পাবে না। পরিবার, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী থেকে মুখ লুকিয়ে বেড়াবে। সুবহানআল্লাহ। একবার চিন্তা করুন কি ভয়াবহ অবস্থ এই সমাজের, আমাদের সিস্টেমের।
তাই তোমরা যারা এ+ পাওনি তাদেরকে বলি শোনো, কখনো মন খারাপ করবে না। এই দেখো আমরা দুই গোল্লায় যাওয়া বন্ধু এখন একজন মেডিকেলে পড়ে আরেকজন ঢাকা ভার্সিটিতে। অথচ আমাদের অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। আর কিসের জন্য টেনশান করবে? কার ভয়ে পালিয়ে বেড়াবে? তোমার চারপাশের মানুষগুলোর জন্য? তারা কি বলবে এই ভয়ে? বাবা মা কি বলবে এই ভয়ে? কিন্তু একটা কথা মনে রাখবে, দিনশেষে তুমি কী চাকরি করো, কতো বেতন পাও মানুষ এটারই দাম দেবে। তুমি কত ভালো রেজাল্ট করেছ সেটা একদিন মানুষ ভুলে যাবে, এমনকি তোমার বাবা-মা আত্মীয়স্বজনও।
এই আমাকে দেখো, আমি একসময় ক্লাসে সবসময় প্রথম হতাম এটা কারো কাছে এখন কোনো মূল্য নেই, একসময় প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় ম্যাথে কত পেয়েছি, ইংলিশে কত পেয়েছি এর কোনো কিছুরই কোনো মূল্য কারো কাছে নেই। ক্লাস এইটে বৃত্তি, মাধ্যমিকে এ+ কোন কিছুই মানুষ আর গোণে না। অথচ এগুলোর জন্য তখন আমরা চোখের ঘুম হারাম করেছি, পেটে ভাত হজম হয়নি। এরপরই মানুষ জানতে চাই সে কোন কলেজে পড়ে, এরপর এইচ এস সি রেজাল্ট কি, এটা পার হওয়ার পর একটাই পরিচয় সে এখন কোথায় পড়ে! অমুক ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে এটাই আমার পরিচয় এখন তাদের কাছে, এসব ছাড়া আমার অতীতের কোনো কিছুই এদের কাছে রেকর্ড নেই। এরপর যখন ভার্সিটি লাইফ শেষ হবে তখন এই পরিচয়টাও ভুলে যাবে। তারপর জিজ্ঞেস করবে কি চাকরি করে, কত বেতন পায়। যার চাকরি যত বড়, যার বেতন যত বেশি তার মূল্য তত। তোমার এতদিনের এত এত সার্টিফিকেট, মেধার কোনো মূল্য নেই কারো কাছে, এমনকি তোমার পরিবারের কাছেও না। স্কুলে ঝরে পড়া তোমার বন্ধুটা বিদেশ গিয়ে কাঁচা টাকা কামিয়ে গর্দান মোটা করে ফিরেছে, তার টাকার দাম একদিন তাদের কাছে তোমার ভালো রেজাল্টের চেয়ে বেশি হয়ে যাবে। সুতরাং তুমি কাদের কথা ভেবে টেনশন করছ, কাদেরকে ভয় পাচ্ছ? বিশ্বাস করো তুমি তাদেরকে কোনদিন খুশি করতে পারবে না। কোনোদিন না।
এই দুনিয়া, এই সমাজ, এই সিস্টেম চায় তুমি দৌড়ের উপর থাক, তুমি ছুটটেই থাক। এতটুকু অবসর সে তোমাকে দিতে চায় না। সে তোমাকে জীবনের সব সত্য থেকে ভুলিয়ে রাখতে চায়। কোনদিন কি ভেবে দেখেছো তোমার দুই কাঁধের দুই ফেরেশতার লেখা খাতায় তোমার এ+ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে কিছুই লেখা নেই, তাদের কাছে এসবের কোনোই মূল্যই নেই? ভেবেছো কোনদিন? তারা লিখবে না তুমি কোন কলেজের স্টুডেন্ট, তারা লিখবেনা তুমি ইন্টারে কি রেজাল্ট করেছ, তারা লিখবেনা তুমি কোথায় চান্স পেয়েছ, লিখবেনা তুমি কত ভালো চাকরি কর, কত বেতন পাও।
আসল কথা কি জানো? নিজেদের লাইফের পারপাস ঠিক নেই বলে আমরা এখনো পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে মন খারাপ করি, গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করতে পারি। যার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছি, যার জন্য জীবনের সবকিছু বিলিয়ে দিচ্ছি সেই দুনিয়া আর এর মানুষগুলো কোনদিনও আমাদের উপর সন্তুষ্ট হবে না। তুমি যদি দুইটা সোনার পাহাড়ও তাদের সামনে হাজির করো তারা মুখ বাকিয়ে বলবে, সব ঠিক আছে কিন্তু বামপাশের পাহাড়টা ডানপাশের চেয়ে একটু ছোট মনে হচ্ছে! কেমন মলিনও লাগছে! That's dunya brother, that's dunya! এস এস সির এ+ এরা ভালো কলেজে ভর্তি হতে না পারলে ভুলে যাবে, ভালো কলেজের পার্ট দেখানো, এসএসসাইট এ+ না পেলে মিইয়ে যাবে, এ+ এর গৌরব ভালো কোথাও চান্স না পেলে হারিয়ে যাবে , আর সবকিছুই বৃথা যাবে ভালো চাকরি না পেলে! এটাই দুনিয়ার ধর্ম।
শেষ করব একটা ঘটনা দিয়ে। আবু উবাইদা (রাঃ) তখন সিরিয়ার ওয়ালী। একবার খলিফা উমার (রাঃ) গেলেন সেখানে। তিনি আবু উবাইদার বাড়িতে যেতে চাইলেন। আবু উবাইদার বাড়িতে গিয়ে তিনি দেখলেন বাড়িতে বলতে গেলে কিছুই নেই। উমার (রাঃ) বললেন, আমার খুব ক্ষিদা লেগেছে তোমার বাসায় কি খাওয়ার কিছু নেই? উমার (রাঃ) কে ছাতু বা এরকম কিছু এবং পানি দেওয়া হল। উমার (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাড়ীতে কি এর চেয়ে ভালো কিছু নেই? উত্তরে আবু উবাইদা বললেন, "এতটুকুই আমাকে ওপারে নিয়ে যেতে যথেষ্ট"। একথা উমার (রাঃ) কে এতটাই স্পর্শ করল যে তিনি অনেক্ষণ কাঁদলেন।
আমি বলছিনা তোমাকে দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে দিতে হবে। তবে নিজের জীবনের পারপাস নিশ্চিত করাটা খুব বেশী জরুরী। ততটুকুই যেন তোমার উদ্দেশ্য হয় যতটুকুতে এই দুনিয়া পার হওয়া যাবে। দেখ, এই দুনিয়া একটা পাগলা ঘোড়ার মতো। এর উপর সওয়ার হয়ে তুমি এর লাগান ধরে রাখতে পারবে না। এটা তোমাকে মাটিতে ফেলে দিবে, তোমাকে পাড়াবে, রক্তাক্ত করবে, তোমাকে ক্ষতবিক্ষত করবে। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হলো আখিরাতের ঘোড়ার উপর সওয়ার হওয়া। তবে এই রাস্তাটাও সহজ নয়। প্রয়োজন সবর, ঈমান, তাওাক্কুল আর ইবাদাত গুজার হওয়া। এখানে তুমি কখনোই চিরস্থায়ী সুখ পাবে না, নিশ্চিন্ত হতে পারবে না। তার জন্য আমরা এখানে আসিওনি। তাহলে আমাদের শান্তি কোথায়, চিরস্থায়ী নিশ্চিত জীবন কোথায়?
ইমাম আহমদ (রাহিমাহুম্মাহর) ছেলে উনাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা শান্তি পাবো কবে? জবাবে ইমাম আহমদ বললেন, "জান্নাতে আমাদের প্রথম কদমটি রাখার পর থেকে।"
আল্লাহ আমাদেরকে সেদিনের জন্য আমল করার, সেদিনের জন্য টেনশান করার, সেদিনের জন্য ভীত হওয়ার তৌফিক দিন। আমীন।
©Bujhtesina Bisoita Page এর Admin
No comments