Header Ads

Header ADS

বই পড়ুন, জীবন গড়ুন!

মানুষের আলোকিত জীবনের উপকরণ হচ্ছে বই। জগতে শিক্ষার আলো, নীতি-আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সভ্যতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি—সবই জ্ঞানের প্রতীক বইয়ের মধ্যে নিহিত। মানবজীবন নিতান্তই একঘেয়ে দুঃখ-কষ্টে ভরা, কিন্তু মানুষ বই পড়তে বসলেই সেসব ভুলে যায়। পৃথিবীতে বিনোদনের কত কিছুই না আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু বই পড়ার নির্মল আনন্দের কাছে সেগুলো সমতুল্য হতে পারেনি। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিমূলক কোনো মজাদার বইয়ের বিষয়বস্তু বা ঘটনা মানুষ সহজে ভুলে যায় না। তাই জীবনের অবসর সময়গুলো বইয়ের নেশায় ডুবে থাকা দরকার। মুসলমানদের ঐশী ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআনের প্রারম্ভিক বাণীতেই পড়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে,

‘পাঠ করো! তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে জমাট রক্ত থেকে সৃষ্টি করেছেন। পাঠ করো! আর তোমার প্রতিপালক মহিমান্বিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সূরা আল-আলাক, আয়াত-১-৫)

জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা মানুষকে ধর্মভীরু ও মহৎপ্রাণ করে তোলে, চিত্তকে মুক্তি দেয় এবং মানবাত্মাকে জীবনবোধে বিকশিত করে। বিভিন্ন বিষয়ে সুশৃঙ্খল ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানার্জন এবং পরিপূর্ণ মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে হলে অবশ্যই বই পড়া দরকার। পাঠকসমাজ নিজস্ব পছন্দ ও রুচি অনুযায়ী বই নির্বাচন করে অগাধ জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে। একদিকে স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন; অপরদিকে বিদ্যার্জনের দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। আল-কোরআনের শিক্ষার আলোকে রাসুলুল্লাহ (সা.) জ্ঞানার্জনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন,

‘বিদ্যা অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ।’ (বায়হাকি)

সুস্থ, সুন্দর ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। বই মানুষের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটায়, মননশীলতার সম্প্রসারণ ও জ্ঞানের গভীরতা বাড়ায়। ভবিষ্যৎ চিন্তার জন্য বই পড়ার আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। বই পড়ার আনন্দে ও আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে পাঠক-পাঠিকাদের নামতে হবে। বড় মনের মানুষ হওয়ার জন্য সবাইকে বইয়ের সান্নিধ্যে আসতে হবে। একটি বইয়ে লেখক তাঁর সুপ্ত ভাবনাকে সৃজনশীল লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। কবি-সাহিত্যিক-লেখকেরা তাঁদের মনের আলো বইয়ের পাতায় ঢেলে দেন, বই পড়ে সেই জ্ঞানের আলো সংগ্রহ করা যায়। বই পড়া সচেতন মানুষের হাতেই দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ ও স্থিতিশীল। যারা বড় হতে চায়, তাদের প্রয়োজন বেশি বেশি করে বই পড়া। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু তিনটি আমলের সওয়াব জারি থাকে।

১. সাদকায়ে জারিয়া, ২. এমন বিদ্যা বা জ্ঞান, যা থেকে লাভবান হওয়া যায় এবং ৩. সুসন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম)

অনেকে বই পড়া থেকে দূরে সরে গিয়েই বিভ্রান্তির পথে হারিয়ে যায়। তাদের বোঝাতে হবে যে বই শুধু মানুষের মেধা ও প্রজ্ঞাই বৃদ্ধি করে না, বরং বই পাঠে মানুষ হয়ে ওঠে কর্মোদ্যম, সহনশীল ও সহমর্মী। বেশি বেশি বই পড়ে পাঠক-পাঠিকারা খুঁজে নিতে পারে জীবনের শুদ্ধতম আনন্দ। শিক্ষা না থাকলে কোনো জাতি আলোর মুখ দেখে না। উন্নতির উচ্চ শিখরে অবতীর্ণ হতে পারে না। মানুষ বই পড়েই নিজেকে জানতে পারে এবং নিজের জীবনকে গড়ে তুলতে পারে। একটি ভালো বই যেকোনো সময় যেকোনো মানুষকে আমূল বদলে ফেলতে পারে। তার মানবিক সুকোমল বৃত্তিগুলো বিকশিত করে তাকে দায়িত্বসচেতন, দেশপ্রেমিক ও বুদ্ধিদীপ্ত নাগরিকে পরিণত করে। সে জন্য বই হচ্ছে মানুষের উৎকৃষ্ট বন্ধু। পাঠচর্চা না থাকার কারণে সমাজে মানবিকতা, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যপ্রীতি বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই পাঠচর্চার দিকে অধিক দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সৃষ্টিজগতে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে মানবজাতিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রদানের লক্ষ্যে আল্লাহ তাআলা ‘শিক্ষা’সংক্রান্ত বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রশ্নবোধক করেছেন,

‘বলো! যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান?’ (সূরা আজ-জুমার, আয়াত: ৯)

যুগ যুগ ধরে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত মানুষেরাই প্রগতির ধারা সৃষ্টি করেছেন। তাই দেশকে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী করে গড়ে তুলতে বই পড়ায় সচেষ্ট হতে হবে। স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হলে নতুন প্রজন্মকে সুশিক্ষিত হয়ে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে দেশকে আগামীর পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে ও মানুষকে ভালোবাসতে, দেশকে ভালোবাসতে এবং একজন সার্থক মানুষ হতে প্রয়োজন বইয়ের আলো। উন্নত জাতি ও রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হলে জ্ঞান ও শিক্ষার সমন্বয়ের পাশাপাশি বড় মনের আলোকিত মানুষ হতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে যত বেশি বই তুলে দেওয়া যাবে, ততই তারা জ্ঞানসমৃদ্ধ হবে। দেশকে নেতৃত্ব দেবে সেই তরুণ প্রজন্মকে যোগ্য করে তুলতে পাঠের বিকল্প নেই। ‘বই পড়ুন, জীবন গড়ুন’—এ জাতীয় স্লোগানকে বাস্তবায়ন করতে হবে।
বড় স্বপ্ন দেখতে হলে আর বড় মনের জন্য চাই বই পাঠের সুঅভ্যাস। ছাত্রজীবন থেকে বই পড়ার অভ্যাস করা উচিত। গ্রামগঞ্জে যদি একটি করে পাঠাগার গড়ে তোলা যেত এবং প্রতিবছর বই কেনার ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে সমাজের বিত্তহীনদেরও বই পড়ার সুযোগ হতো এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেধা ও মননের চর্চা হতো। ফলে জ্ঞানের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত। এ জন্য সারা দেশে স্কুল-কলেজের বার্ষিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বই কিনতে হবে এবং বই পুরস্কার দিতে হবে। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা পুরস্কার হিসেবে প্রাপ্ত বইগুলো অন্তত পড়ে দেখবে। এ জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা বিভাগ থেকে স্কুল-কলেজের বার্ষিক সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়ার জন্য দিকনির্দেশনা অথবা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করা যায়। আত্মীয়স্বজনের বিয়ে, জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকীতে উপহার হিসেবে প্রিয়জনকে বই কিনে দিতে হবে। বই উপহার দেওয়ার রেওয়াজ চালু হলে সারা জীবন ঘরে বই শোভা পাবে ও বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হবে। তাই অমর একুশের গ্রন্থমেলা থেকে যাঁর যাঁর পছন্দমতো বই কেনা, বই উপহার এবং বই পুরস্কার দেওয়ার সুন্দর মানসিকতা গড়ে তুলুন।


ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com


No comments

Powered by Blogger.