প্রচলিত কিছু জাল হাদীস - ধাক্কা খেতে পারেন!
আমি 'ধাক্কা' খেয়েছি, আপনিও খেতে পারেন.... !!
____________
.
মনে করি, (ছোটবেলা থেকে জেনে আসছি) বাটা কোম্পানি হলো বিস্কুটের কোম্পানি, নাবিস্কো কোম্পানি হলো জুতার কোম্পানি। বড় হবার পর বাটা আর নাবিস্কো কোম্পানিতে গিয়ে যখন দেখলাম বাটা কোম্পানি জুতোর কোম্পানি আর নাবিস্কো হলো বিস্কুটের কোম্পানি, তখন যে একটা ধাক্কা (shock) খাবো সেটা ধরেই নেয়া যায়। ছোটবেলা থেকে যা জেনে আসছি, একটা সময় যখন জানতে পারবো তা 'ভুল', তখন ধাক্কা খাওয়াটাই স্বাভাবিক।
.
আবার এরকম যদি হয়, ছোটবেলা থেকে কোনো আমল করে আসছি একে সুন্নাত (!) জেনে, এর অনেক ফযিলত আছে এটা শুনে। কিন্ত একটা সময় যখন জানতে পারলাম, কিছু জিনিস যা সুন্নাত জেনে পালন করে আসছি তা আসলে সুন্নাত না বরং তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে রটানো মিথ্যা, জাল হাদীস। তখন যে 'ধাক্কা' খাবো সেই ধাক্কা বিস্কুট আর জুতোর কোম্পানির ধাক্কার চেয়েও বড় ধাক্কা। কারণ বিস্কুট আর জুতোর কোম্পানি সম্পর্কে ভুল তথ্য জেনে আসছি আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস সম্পর্কে ভুল তথ্য জানার পাশাপাশি সেটার আমল করা, হাদীস মনে করে তা অন্যের সাথে শেয়ার করেও আসছি।
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে মিথ্যা কথা বর্ণনা করতে তিঁনি কঠোরভাবে নিষেধ করেন। আলী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন - তোমরা আমার উপর মিথ্যারোপ করো না। কারণ আমার উপর যে মিথ্যারোপ করবে সে জাহান্নামে যাবে। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১০৬)
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে এমন কিছু জাল হাদীস সমাজে এতোটাই জনপ্রিয় যে, নতুন করে যখন জানতে পারা যায় এগুলো হাদীস না বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে মিথ্যারোপ, তখন মুহূর্তের জন্য মেনে নিতে কষ্ট হয়! এতবার এই হাদীসগুলোর (!) কথা শুনলাম, এগুলো কিভাবে জাল হাদীস হতে পারে?
.
.
সমাজে প্রচলিত এবং জনপ্রিয় কিছু জাল হাদীস :
____________
.
❏ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষা বইয়ে পড়ে এসেছি "দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ"। অথচ এটা কোনো হাদীসই নয়।
মোল্লা আলী কারী (রহ:) বলেন, "হাফেযে হাদীস মুহাদ্দেসীনে কেরামের নিকট এর কোনো ভিত্তি নেই।" (আল মাসনূ: পৃষ্ঠা ৯১)
.
❏ জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝাতে গিয়ে আরেকটা জাল হাদীস বলা হয়, "জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যাও।"
অধিকাংশ মুহাদ্দিস একে জাল হাদীস বলেছেন। (ইবনুল জাওযী, আল-মাউযূআত ১/১৫৪; সূয়ুতী, আল-লাআলী ১/১৯৩; আলবানী, সিলসিলাতুল যয়ীফা ১/৬০০)
.
❏ "প্রতি ৪০ জনে একজন আল্লাহর ওলী থাকেন" এটার কোনো ভিত্তি নেই আর কথাটাও বাতিল। কেননা কখনো গোটা জামাতই বে-দ্বীন, ফাসেক হতে পারে। মোল্লা আলী কারী রহ: বলেন, "এটা একটা বাতিল কথা এবং এর কোনো ভিত্তি নেই।" (আল মাসনূ ১৬১, শরহুল আকীদাতিত তহাবিয়া ৩৪৭-৩৪৮)
.
❏ "আসসালাতু মিরাজুল মুমিনীন" অর্থাৎ, নামাজ মুমিনের মেরাজ। এ অর্থের কাছাকাছি অনেক সহীহ হাদীস আছে তবে এই কথাটি ভিত্তিহীন। (মালফুযাত ফাকীহুল উম্মাহ, পৃষ্ঠা ১৭)
.
❏ "পাগড়ী বিশিষ্ট দু'রাকাআত নামায, পাগড়ীবিহীন ৭০ রাকাআতের চেয়েও উত্তম।"
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ: বলেন, "এটিও একটি মিথ্যা এবং বাতিল।" (শরহু জামায়িত তিরমিযী, ইবনে রজব রহ: ২/৮৩, পাণ্ডুলিপি, আলবানী, সিলসিলাতুল যয়ীফাহ ৩/২৪, সাখাবী, আল-মাকসাদিদ, পৃ: ২৯৮)
.
❏ নখ কাটার নিয়ম সংক্রান্ত জাল হাদীস:
"রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডান হাতের তর্জনী হতে নখ কাটা আরম্ভ করে বৃদ্ধাঙ্গুলে শেষ করতেন। বাম হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুল হতে আরম্ভ করে বৃদ্ধাঙ্গুলে শেষ করতেন।"
.
ইবনে হাজার আসকালানী রহ: বলেন, "নখ কাটার নিয়ম সম্পর্কে কোনো হাদীস প্রমাণিত নেই।" (ফাতহুল বারী, ১০/৩৫৭)
.
❏ খাবার শুরুতে লবণ খাওয়ার উপকারিতা সংক্রান্ত জাল হাদীস:
"খাবারের শুরু ও শেষ লবণ দিয়ে কর। কেননা লবণ সত্তরটি রোগের ওষুধ।"
.
ইমাম বায়হাকী, ইবনুল জাওযী, ইবনুল কাইয়্যুম, হাফেজ সুয়ূতী এবং ইবনে আররাক প্রমুখ মুহাদ্দেসীনে কেরাম একে জাল হাদীস বলেছেন। (দালায়েলুন নবুওয়ত, ৭/২২৯, আল-মানারুল মুনীফ ৫৫)
.
❏ "জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম/পবিত্র"।
সাখাবী, যারকানী, মোল্লা আলী কারী প্রমুখ মুহাদ্দিস জানিয়েছেন যে, কথাটি খুব সুন্দর শুনালেও তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথা নয়। যারকাশী বলেছেন, বাক্যটি আসলে তাবিয়ী হাসান বসরী রাহ: এর উক্তি। (সাখাবী,আল-মাকাসিদ, ৩৭৭ পৃষ্ঠা; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ ১৭২ পৃষ্ঠা; মোল্লা আলী কারী, আল আসরার ২০৭ পৃষ্ঠা)
.
❏ আসমানী কিতাব নিয়ে জাল হাদীস, যা ইসলাম শিক্ষা বইয়ে পড়ে আসছি:
আসমানী কিতাব ১০৪ খানা। বড় আসমানী কিতাব ৪ খানা, ছোট ১০০ খানা (এই ১০০ খানাকে সহীফা বলা হয়)। এই বর্ণনা কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থে পাওয়া যায়না।
.
❏ আসরের পরে লেখাপড়া না করা নিয়ে জাল হাদীস:
"যে ব্যক্তি তার চক্ষুদ্বয়কে ভালোবাসে সে যেন আসরের পরে না লেখে।" কথাটি হাদীস নয়। (সাখাবী, আল-মাকাসিদ পৃ: ৩৯৭; মোল্লা আলী কারী, আল আসরার, পৃ: ২১৬)
.
❏ "এক মুহূর্ত বা কিছু সময় চিন্তা-ফিকির করা এক বছর/ ৭০ বছর/ হাজার বছরের ইবাদত থেকে উত্তম।"
মুহাদ্দিসগণ হাদীসটি জাল বলে উল্লেখ করেছেন। (মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ৯৭; আলবানী, যায়ীফুল জামিয়, পৃ: ৫৮১)
.
❏ "যে ব্যক্তি মসজিদের মধ্যে দুনিয়াবি কথা বলবে, আল্লাহ তার ৪০ বছরের আমল বাতিল বা বরবাদ করে দিবেন।"
আল্লামা সাগানী, মোল্লা আলী কারী, আজলূনী প্রমুখ মুহাদ্দিস একবাক্যে হাদীসটিকে জাল হাদীস বলেছেন। মোল্লা আলী কারী রহ: বলেন, "এ কথাটি যেমন সনদগতভাবে বাতিল, তেমনি এর অর্থও বাতিল। (সাগানী, আল-মাউদূ'আত, পৃ: ৩৯, মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ২২৭)
.
❏ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম শুনে আঙ্গুল দিয়ে চোখ মুছা সংক্রান্ত জাল হাদীস:
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ: বলেন, "মুয়াজ্জিনের শাহাদতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম শুনে আঙ্গুলে চুমো খাওয়া এবং চোখ মুছে দেওয়ার ব্যাপারে যতগুলো রেওয়ায়ত বর্ণিত হয়েছে সবগুলো জাল ও বানোয়াট।" (তাইসীরুল মাকাল- ইমাদুদ্দীন, পৃ: ১২৩)
.
❏ 'যারা একবার হজ্ব করেছে তারা হাজ্বী আর যারা একাধিকবার হজ্ব করেছে তারা আলহাজ্ব' এই সংক্রান্ত ভুল ধারণা:
একবার হজ্ব আদায়কারীকেও আলহাজ্ব বলা যায়, একাধিকাবাররীকেও হাজ্বী বা আলহাজ্ব বলা যায়।
.
❏ "আমি জ্ঞানের শহর এবং আলী তার দরজা।" এই হাদীসটিকে অভিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ এই হাদীসটিকে মিথ্যা না বলে যয়ীফ বলেছেন। ইমাম তিরমিযী এ অর্থে একটি হাদীস বর্ণনা করে নিজেই একে দূর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারী, আবু হাতিম, ইয়াহিয়া বিন সায়ীদ, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদিসটিকে ভিত্তিহীন, মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন। (ইবনুল জাওযী, আল- মাউদূ'আত, ১/২৬১-২৬৫; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৩২৮-৩৩৬; মোল্লা আলী কারী, আল আসরার, পৃ: ৭১-৭২)
.
.
এছাড়াও আরো কিছু প্রচলিত জাল হাদীস:
____________
.
❏ আঠারো হাজার মাখলূকাত সংক্রান্ত বর্ণনা।
❏ প্রতিদিন ২০ বার মৃত্যুকে স্মরণে শাহাদাতের মর্যাদা।
❏ খাওয়ার সময় সালাম না দেওয়া।
❏ মুসাফার পর (হাত মেলানো) বুকে হাত রাখা।
❏ কবরের দিকে আঙ্গুল তুলে ইশারা করলে আঙ্গুল পঁচে যায়।
❏ দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্র।
❏ লাশ বহনের সময় সশব্দে যিকির করা।
❏ ওযুর ভেতরে দো'আ পড়া।
❏ মূর্খের ইবাদাতের চেয়ে আলিমের নিদ্রা শ্রেয়।
❏ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ আসমান যমীন কিছুই সৃষ্টি করতেন না।
❏ তারাবীহ পড়তে না পারলে রোজাও হবেনা।
.
এরকম অসংখ্য মিথ্যাচার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাদের সমাজে। আল্লাহ আমাদেরকে এগুলো বুঝার তাওফিক দান করুন (আ-মি-ন)।
.
.
সহায়ক গ্রন্থ:
____________
.
■ হাদীসের নামে জালিয়াতি
- ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ)
■ প্রচলিত ভুল
- মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক।
■ প্রচলিত জাল হাদীস
- মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক।
■ 100 Fabricated Hadith
- Shaikh Faisal.
■ 100 famous weak and fabricated traditions
- Shaikh Ihsan Al Utaibi.
.
(রেফারেন্সগুলো সহায়ক গ্রন্থ থেকে দেওয়া, বর্ণনা সহ)
.
বিঃ দ্রঃ আমার দ্বিতীয়বার জানার মধ্যেও যদি কোনো ভুল থাকে তাহলে সংশোধন করে দিবেন, ইন-শা-আল্লাহ।
▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂
.
লেখাঃ আরিফুল ইসলাম (আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!)
No comments