আমার কাহাফ ভাবনা - ৫ | আরিফ আজাদ
অনেক অনেক বছর ঘুম পাড়িয়ে রাখার পরে একদিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আসহাবে কাহাফের যুবকদের জাগালেন। ঘুম থেকে উঠবার পর তাদের মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না।
কতো সুদীর্ঘ একটা সময় ঘুমের মধ্যে কাটিয়ে এসেছে তারা— এটা তাদের কল্পনাতেও নেই! তাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা পৃথিবীর কতো পট-পরিবর্তন ঘটালেন, এরইমধ্যে কতো জল যে কতো জায়গায় গড়ালো, কতো ইতিহাস তৈরি হলো আর বিস্মৃত হলো কতো— তার কোন ইয়ত্তা নেই। সবচেয়ে সুখকর ব্যাপার হচ্ছে— যে অত্যাচারী, বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের হাত থেকে জীবন এবং ঈমান বাঁচাতে তারা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছিলো, সেই জালিম এবং জুলুম— পৃথিবী থেকে দুটোর-ই বিদেয় ঘটেছে।
কিন্তু, এসবের বিন্দু-বিসর্গও জানে না যুবকদের কেউ-ই।
তিন শতো বছরেরও বেশি সময় ঘুমিয়ে কাটাবার পরে, যেদিন তাদের সকলের ঘুম ভাঙলো, তাদেরই একজন অন্যদের খুব স্বাভাবিক গলায়, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা কতোক্ষণ ঘুমালে?’
তাদের মধ্য থেকে কেউ উত্তরে বললো, ‘হতে পারে পুরো একটা দিন অথবা একটা দিনের কিছু অংশ’।– আল কাহাফ ১৯
চিন্তা করে দেখুন— তারা তিন শতো বছরের কাছাকাছি সময় ধরে ঘুমিয়েছে, কিন্তু এই দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে পার করে আসার কোন অনুভূতি তাদের মাঝে উপস্থিত নেই। তারা জানেই না যে দুনিয়ার বুকে তারা একটা পরম আশ্চর্য ব্যাপারে পরিণত হয়েছে! তাদের অবস্থা এমন— যেন কোথাও চমৎকার কিংবা আশ্চর্যজনক কিছু ঘটেইনি।
ব্যাপারটা এরকম— কেউ মোঘল আমলের শেষদিকে ঘুমিয়ে পড়লো আর আজকের সকালে জেগে উঠে হাই তুলতে তুলতে বললো, ‘হায় হায়! অনেক বেলা হয়ে গেলো যে! রাত কোনোদিকে কেটে গেলো বুঝতেই তো পারলাম না’।
আসহাবে কাহাফের যুবকদের বেলাতেও তাই হয়েছে। তারা আদৌ জানে না তাদের সাথে কী ঘটেছে। তাদের ধারণা— গুহার ভেতরে তারা সকালে ঢুকলো। চোখে ঘুম নামতেই তারা সেখানে ঘুমিয়ে পড়লো এবং তাদের ঘুম ভেঙেছে বিকেল বা সন্ধ্যার খানিকটা আগে। কিন্তু পশ্চাতে পার করে আসা সহস্র সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা আর রাতের ব্যাপারে তারা একেবারে ওয়াকিবহাল নয়।
অত্যাচারী সম্প্রদায়ের হাত থেকে বাঁচাতে আল্লাহ কেবল তাদের ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। এই ঘুম পাড়ানোটাই ছিলো তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রাহমাহ তথা দয়া। কিন্তু, এই যে এতোবড় দয়া তারা লাভ করলো যার মাধ্যমে তারা পার করে এসেছে জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদ— সেই দয়ার ব্যাপারেই তারা অজ্ঞাত। তারা জানেই না কী এক অতি-আশ্চর্য নিয়ামত তারা লাভ করেছিলো!
এরকম হতে পারে। মাঝে মাঝে আল্লাহ আপনাকে এমনভাবে সাহায্য করেন, এমন উপায়ে আপনার সমস্যাকে দূর করে দেন যে— আপনি জানতেও পারেন না এর পেছনে আল্লাহর কতো সুন্দর পরিকল্পনা কাজ করেছে।
ধরুন আগামিকাল আপনার চাকরির ভাইবা। আপনি মনে করছেন— আপনার মুখে দাড়ি থাকায় তারা হয়তো আপনাকে চাকরিটা দিবে না। ভাইবা-বোর্ডে এক কড়া লোক সকল দাড়ি-ওয়ালা চাকরিপ্রার্থীকে তিরস্কার করে যাচ্ছে বলেও আপনি শুনেছেন।
কিন্তু, পরেরদিন ভাইভা দিতে এসে আপনি সামনে পেলেন এমন একজন মানুষকে যার মুখে সুন্নতি দাড়ি। ভদ্রলোক নিজেও যেহেতু দাড়িওয়ালা, আপনাকে দাড়ির জন্য তিরস্কার করবার প্রশ্নই আসে না তখন। শুধু তা-ই নয়, তিনি আপনার সাথে অত্যন্ত আন্তরিক ব্যবহারও করেছেন।
আরো পরে জানতে পারলেন— আপনার চাকরিটাও হয়ে গেছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো— ভাইভা-বোর্ডে থাকা কড়া মেজাজের লোকটা আপনার ভাইভার আগের দিন বদলি হয়ে যায় অন্যত্র। লোকটা কেনো-ই বা ঠিক আপনার ভাইভার আগের দিন বদলি হয়ে গেলো, আর তার বিপরীতে কেনো ঠিক তার বিপরীত মেরুর একজন এসে ওই চেয়ারে বসলো যে আপনার লেবাসকে পছন্দ করবে, আপনার সাথে হৃদ্যতা দেখাবে— এসবকিছুই আপনার ধারণার বাইরে ছিলো।
একটা মানুষ একটা পোস্ট থেকে বদলি হতেই পারে। তার জায়গায় তার বিপরীত মেরুর কেউ একজনও ওই পোস্টে আসতে পারে। কিন্তু, কেনোই-বা বদলিটা ঠিক আপনার ভাইভার আগের দিন হতে হলো? কেনোই-বা ওই পোস্টে এমন একজনকে আসতে হলো যার সাথে আপনার লেবাসের, আপনার চিন্তার সাদৃশ্য রয়েছে?
এটাকেই বলে 'ফাইন টিউনিং'। সবকিছু একদম সঠিক জায়গায়, সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়া। ওই পোস্ট থেকে আগের লোকটার বদলি হওয়া এবং পরের লোকটার জয়েনিংয়ের পেছনে যথেষ্ট-ই যুক্তি আছে। কিন্তু, যেটার পেছনে কোন যুক্তি নেই সেটা হচ্ছে— এই দুজনের মাঝখানে আপনার চাকরির ব্যাপারটা আল্লাহ যে সহজ করে দিয়েছেন, ওইটাই।
মাঝে মাঝে আল্লাহ আপনাকে এরকম অবিশ্বাস্যভাবে সাহায্য করেন, এরকম অবিশ্বাস্য উৎস থেকে তিনি আপনার জন্য সাহায্য পাঠান। এই সাহায্যগুলোকে আপনি খালি চোখে ' পুরাতন একজনের বদলি হওয়া এবং নতুন একজনের জয়েনিং' হিশেবেই হয়তো দেখেন, যেভাবে আসহাবে কাহাফের যুবকদের কাছে ওই সুদীর্ঘ ঘুমটাকে কেবল 'একটা দিন বা একটা দিনের কিছু অংশ' বলে মনে হয়েছিলো।
তারা যেমন কল্পনাও করতে পারেনি যে কতো লম্বা একটা সময় ধরে তারা ঘুমিয়ে ছিলো, তেমনি আপনিও কল্পনা করতে পারেন না— ওই লোকটাকে, ওইদিন ওই জায়গা থেকে বদলি করতে এবং নতুন আরেকজনকে ওই চেয়ারে এনে বসাতে নতুন করে কতো জায়গায় কতো রদবদল করতে হয়েছে। আপনি এসবের কিচ্ছু জানেন না, যেমন করে সেই সুদীর্ঘ ঘুমের ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গও জানতো না আসহাবে কাহাফের যুবকদল।
আসহাবে কাহাফের যুবকদল কী নেয়ামতের দ্বারা, আল্লাহর কোন সাহায্যের দ্বারা জালিম সম্প্রদায়ের হাত থেকে বাঁচবে তা জানতো না। তারা কেবল জানতো— তারা যে ইলাহের ইবাদাত করে তিনি সর্ব বিষয়ের ওপরে ক্ষমতাবান। তিনি যেকোন উপায়েই তাদের জীবন এবং ঈমানকে হেফাযত করবেন।
তেমনি, আপনিও জানেন না যে আল্লাহ আপনার রিযিক কোন উৎস থেকে, কোন জায়গা থেকে পাঠাবেন। আপনি শুধু জানেন— রিযিকের ফয়সালাটা আসমান থেকে আসে, যমিন থেকে নয়। যমিনের কেউ যদি আপনার মুখের দাড়ি দেখে আপনাকে চাকরি না দেয় তো কী হয়েছে? মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু যিনি আর-রাযযাক, সেই উত্তম রিযিকদাতা কখনোই মুখ ফিরিয়ে নেন না। আপনার রিযিক আপনার কাছে আসবেই।
আসহাবে কাহাফের যুবকদল তাদের দৃঢ় তাওয়াক্কুলের পুরস্কার ঠিক-ই পেয়েছিলো। পুরস্কারটা ছিলো— জালিম সম্প্রদায়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি। কিন্তু পুরস্কারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তারা ছিলো বে-খবর।
আপনার তাওয়াক্কুলের পুরস্কারটাও আপনি পেয়ে যান মাঝে মাঝে। হতে পারে সেটা দুষ্ট কোন লোকের বদলি এবং ভালো কোন লোকের জয়েনিংয়ের মাধ্যমে। পুরস্কার আপনি পান ঠিক-ই, কিন্তু তার প্রক্রিয়াটা বুঝে উঠা মুশকিল হয়ে যায়।
আপনার জন্যে আল্লাহর সাহায্য কী উপায়ে আসছে তা আপনার বিবেচ্য নয়। ওই প্রক্রিয়া আপনার না জানলেও চলে। সেটা আল্লাহর দিকেই সোপর্দ করে দিন। আপনি কেবল আপনার তাওয়াক্কুলের জায়গাটাকে মেরামত করুন, ব্যস।
No comments