Header Ads

Header ADS

বিয়ে বিষয়ক ফালতু সামাজিকতা | ওমর আলী আশরাফ

বিয়ে বিষয়ক ফালতু সামাজিকতা

মুরব্বিদের সঙ্গে আমাদের যে বিষয়গুলো বনে না, প্রসঙ্গ তুলে সেগুলোর মীমাংসা হওয়া উচিত। মুরব্বিরা বর্তমানকে ভাবেন তাদের তরুণবেলার সঙ্গে তুলনা করে। বিপত্তিটা এখানেই ঘোঁট পাকিয়ে গুরুতর হয়। সেই রকম অতি গুরুতর এবং ভয়াবহ একটা প্রসঙ্গ বিয়েশাদি।

বিয়েশাদি করে একত্র বাসের সর্বনিম্ন বয়স ছেলের বারো, মেয়ের নয়। আমাদের সরকারি বিধান মতে ছেলের আঠারো, মেয়ের ষোল। ইসলাম বলে, বালেগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েদের বিয়ে পড়িয়ে দাও।
পৃথিবীর কাল পরিবর্তনের স্তরগুলো যখন দেখি, আদিযুগ, প্রস্তরযুগ, হাতিয়ারযুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ; হিন্দুমতে সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দাপরযুগ, কলিযুগ—কালপরিক্রমার প্রতিটি খাঁজে খাঁজে মানুষের জীবন চাহিদা চরিত্র অঙ্গীকারের নানান রূপ দেখি। আমরা পেছনের বুলি কপচাব না, বর্তমান নিয়েই কথা বলি।

মানুষের দুটি ধারা আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। একটা তেল, একটা জল—দুইটাই তরল—মানুষ। অঙ্গসৌষ্ঠবের বৈশিষ্ট্যে মহান আল্লাহ যেমন দুটি ভিন্ন ধারায় বৈচিত্র্য দিয়েছেন, মন ও কামনায় এককে অন্যের প্রতি আগ্রহী রেখেছেন। পৃথিবীতে মানুষের ক্রমধারা রক্ষার এই এক সুমহান ব্যবস্থাপনা। এর অর্থ, আপনার যখন একজন ছেলে আছে, তাকে অবশ্যই বিয়ে করিয়ে ঘরে পুত্রবধূ আনতে হবে; আপনার যখন মেয়ে আছে, তাকে বিয়ে দিয়ে অন্যের ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। এই এক অনুপম ও সঙ্গত রেওয়াজ।
সময় পরিক্রমার এই কলি কিংবা আধুনিক যুগে আমরা তরুণরা যে সমস্যা, সঙ্কীর্ণতা ও অসঙ্গতি ফেস করছি, সম্ভবত এর আগে কোনো কালের মানুষের ভাগ্যে এমনসব বিড়ম্বনা জোটেনি। আগেকার মানুষেরা—আমাদের বাপ-চাচারাও বয়স উপযুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ে করে ফেলেছেন।
আমাদের এই কালে একজন ছেলেকে আগে কয়েকটা ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। তারপর একটা মানানসই চাকুরি যোগাড় করতে হয়। মোটা অঙ্কের স্যালারি ঘরে তুলতে হয়। তারপর বাবা-মা বিয়ের প্রসঙ্গ তোলেন। ততদিনে ছেলের কেল্লাফতে; বয়স ত্রিশ পার।
ত্রিশ বছরের ছেলের জন্য মেয়ে খোঁজা হয় চৌদ্দ বছরের। ছেলে একেবারেই পোক্ত, মেয়ে এখনো পুতুল খেলে। স্বামীর ঘর বোঝে না। শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা খেদমত করতে জানে না। নিজেই বাচ্চা, কোল আলো করে যদি একটা বাচ্চা এসে যায়, তার লালনপালন করতে জানে না। বাচ্চা কাঁদে খিদেয়, পনেরো বছর বয়সী মা ভাবে ওইটা তো এমনিই কাঁদছে! তার কাজই তো হলো রাতদিন কেবল কান্নাকাটি করা। এসব নিয়ে স্বামীর সঙ্গে লেগে যায় খিটিমিটি, সংসার না বোঝায় শ্বশুর শাশুড়ি মহাবিরক্ত। লাগে ক্যাঁচাল।
গ্রাজুয়েট শেষে, স্টাবলিশ হয়ে ছেলে বিয়ে করে বয়স ত্রিশের ঘর পার হবার পর। এইকালে মানুষের গড় আয়ু ষাট বছর। বিয়ে করে অর্ধেক জীবন পার হয়ে যাওয়ার পর। চল্লিশ বছরের পর থেকে মানুষের শারীরিক সক্ষমতা ক্রমে দুর্বল হতে থাকে এবং পঞ্চাশ ছোঁয়ার আগেই রোগব্যাধির দল হল্লা করে শরীরে বাসা বেঁধে ফেলে। তার মানে, বিয়ের পরে সে বাঁচল ধরুন ত্রিশ বছর, সুস্থ সময় পেল আনুমানিক বিশ বছর। বিয়ের এক বছর পরে যদি বাচ্চা হয়, এই সময়ে তার বয়স হবে উনিশ বছর। বড় বাচ্চার বয়স উনিশ, একাধিক হলে ক্রমে নিচে নামবে। উনিশ বছরের একটা ছেলে হয়তো ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে। এই সময় বাবা অচল হয়ে গেল। মানে এখনকার তরুণ আমরা যারা—যখন বয়স্ক হব—আমাদের বার্ধক্যে আমাদের ছেলেপুলের কী ভয়াবহ ভবিষ্যৎ হবে, ব্যাপারটা কি আপনারা অনুমান করতে পারছেন? এটা তো বড় সন্তানের হিসেব, ছোট সন্তানের বয়স যদি বারো-তেরো হয়! তাদের বয়স ত্রিশ হওয়া পর্যন্ত বাবা আর বেঁচে থাকবে না। মানে আমরা মরবার আগে আমাদের ছেলেদের বিয়ে করিয়ে যেতে পারব না।

আমাদের চলমান সমাজে বিয়ে বিষয়ক অনীহার কারণে উদ্গত কুফলের এই গেল একদিক। দ্বিতীয় দিক বর্তমান।
আমাদের পূর্ববর্তীদের কালে ইন্টারনেট প্রযুক্তি ছিল না। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শের বিস্তৃতি খুব সামান্য ছিল। তরুণ বয়সের ছেলেমেয়েরা মুখোমুখি হবার এত সুযোগ, উপকরণ, মাধ্যম এবং চর্চা ছিল না। এখন আছে। এবং প্রযুক্তি সময় বাস্তবতা সঙ্গ প্রতিনিয়ত মানুষের কামনাকে উস্কে দিচ্ছে। মনের মিলন এবং শারীরিক আকর্ষণের প্রভাবে ছেলেমেয়েরা একে অন্যের ভেতর নিজেকে খুঁজে ফিরছে। বিয়ে হয়নি, কী হয়েছে! শরীর এবং চাহিদা তো আছে! দাও গাড়ি স্টার্ট। এক্সিডেন্টের ফল ভোগ করবার ভয় নেই, নানা রকম মেডিসিন ও উপকরণ আছে বাজারে। চালিয়ে যাও পুরো উদ্যোমে।
এই যে যিনা হলো, ব্যভিচারে উন্মত্ত সমাজ; বিবাহিতদের মধ্যে কি এসবের প্রকোপ এত উৎকট আকারে দেখা যায়? সুতরাং ছেলেমেয়েদের যে গ্রাজুয়েট বানাবার নাম করে পরোক্ষভাবে ব্যভিচারে ইন্ধন দিচ্ছেন, এর পাপভার নিবেন কি আপনারা হে মুরব্বিরা?! 

এইযে শিক্ষিত, কর্মঠ ওরফে ব্যভিচার প্রজন্ম আমাদের এই বাংলাদেশে শক্তপোক্তভাবে তৈরি হয়ে গেল, সমাজ সংস্কারকরা এর কী ব্যাখ্যা দেবেন?
বাল্যবিবাহ রোধ করছেন, তাতে আপত্তি করছি না। অন্তত নিষেধাজ্ঞার দেয়াল পার হয়ে গেলে, অর্থাৎ ছেলেমেয়ের বয়স আঠারো হলেই তো বিয়ের আয়োজন করে ফেলতে পারেন! সেটা করেন না, উল্টো ব্যাঙ্গ করেন, "বিয়ে করে বউরে খাওয়াবি কী?"
হুম, আপনার ছেলে বিয়ে করছে না। বউকে খাওয়ানোর টেনশনও নেই। শ্রমজীবী হলে সে বেশ্যাপাড়ায় যাচ্ছে। ছাত্র হলে জাস্টফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড বানাচ্ছে, তারপর হোটেলে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী আমাকে বলল, "ভাইয়া! আপনারা মাদরাসায় পড়ছেন, অনেক ভালো আছেন। ভার্সিটির অবস্থা শুনলে আপনি স্থির থাকতে পারবেন না। ছেলেমেয়ে দুইজনে যে যার হলে না থেকে একত্রে বাসা ভাড়া করে থাকছে। ছেলে বাজার করছে, মেয়ে রাঁধছে। একত্রে তারা স্বামী-স্ত্রীর জীবনযাপন করছে। ভার্সিটি পড়া শেষ, যে যার মতো তল্পি  গুটিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে। মাঝখানে পড়া হলো, আরামে থাকা এবং মজাদার খাওয়া হলো, তারপর শারীরিক কামনা পূর্ণ হলো, আর কী চাই!"

আমাদের সমাজ যে পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, কিছুদিন পরে হয়তো বিয়ে প্রসঙ্গটা ইতিহাস হয়ে যাবে। এখনই যদি দেখে বিশ বছরের কম বয়সের কোনো ছেলে বিয়ে করেছে, সবাই চোখ কপালে তুলে ব্যাঙ্গ করে। যদি দেখে পনেরো বছরের ছেলে জরিনার হাতধরে বেলতলায় যাচ্ছে, এটাকে স্বাভাবিক মনে করে। আমাদের সমাজ আমাদেরকে ব্যভিচার প্রজন্ম করছে এবং বিয়ের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করছে। এইযে অবাধ ব্যভিচার হচ্ছে, আল্লাহর দরবারে এগুলোর দায় কে দেবে?
অথচ হাদিস শরিফে ছেলেমেয়ে বালেগ হবার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে দিতে মুরব্বিদের আদেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু ইসলাম নয়, অন্যসব ধর্মেও বিয়েকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হচ্ছে না শুধু আমাদের এই সমাজে। প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে পদে পদে। অতি নিকৃষ্ট এই সমাজ।
আমি শপথ করে বলতে পারি, অপরাধপ্রবণ আমাদের এই সমাজ যদি আপনি সত্যি সত্যি সংস্কার করতে চান, উপযুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিন। বিবাহিত ছেলের বাইরে আড্ডা কমে যাবে। বদ বন্ধুদের খপ্পর অনায়াসেই এড়াতে পারবে। মদ গাঞ্জা ছিনতাই ধর্ষণের হার অবশ্যই কমে যাবে। বিশ্বাস না হয় একবার চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেখতে পারেন।

--
বিয়ে বিষয়ক ফালতু সামাজিকতা
ওমর আলী আশরাফ
১৩ ডিসেম্বর, ১৮ ঈ.

No comments

Powered by Blogger.